ইতিহাস ও সমকাল। শিবজির রাজ্যাভিষেকের ৩৩৬তম জয়ন্তী। করড়, মহারাষ্ট্র, মে ২০১৫। ছবি: পিটিআই।
ই তিহাস জিনিসটা সব সময়েই ‘সমসাময়িক’। কেননা, ইতিহাসের মাধ্যমে অতীতের যে উদ্ধার আমরা করে থাকি, তার মধ্যে মিশে থাকে বর্তমানের নানা দ্বন্দ্ব। তাই, আশ্চর্য নয় যে একুশ শতকের মহারাষ্ট্রে ষোড়শ শতকের মরাঠা রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শিবজিকে নিয়ে ব্রাহ্মণরা যে ইতিহাস রচনা করবেন, অব্রাহ্মণদের শিবজি-আখ্যান তার থেকে অনেকটাই আলাদা হবে। এই বছর মহারাষ্ট্র সরকার যখন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও লেখক শিব শাহির বালাসাহেব পুরন্দরে-কে মহারাষ্ট্র ভূষণ পুরস্কারে সম্মানিত করার কথা ঘোষণা করল, তখন ইতিহাস-রচনার অন্দরের এই দ্বন্দ্বটাই একেবারে সামনাসামনি চলে এল। বিরানব্বই বছরের লেখক শিব শাহির এখনও সামাজিক সাংস্কৃতিক জগতে যথেষ্ট সক্রিয়। শিবজিকে নিয়ে তাঁর অতীব জনপ্রিয় বই ‘রাজা শিব ছত্রপতি’ এবং তার উপর ভিত্তি করে প্রযোজিত নাটক ‘জাণতা রাজা’ (জ্ঞানী রাজা), দুটিকেই শিবজি-সংক্রান্ত সাহিত্যে ‘মাস্টারপিস’ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রাহ্মণ-বিরোধী শম্ভাজি ব্রিগেড-এর পক্ষ থেকে দাবি উঠে এল যে— পুরস্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হোক, কেননা শিব শাহির যে ভাবে শিবজি-জীবন বর্ণনা করেছেন, তাতে হিন্দু মুসলমান শত্রুতার সূত্রটিই শেষ পর্যন্ত সমর্থিত হয়েছে। এই নিয়ে বিতর্ক এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে শেষ পর্যন্ত নবতিপর ইতিহাসবিদের জন্য ২৪ ঘণ্টার পুলিশি প্রহরা নিয়োগ করতে হয়।
শম্ভাজি ব্রিগেড এতেই থেমে থাকেনি। পুরন্দরের বইয়ে কুনবি নামক সম্প্রদায়ের মহিলাদের প্রতি বহু অপমানজনক উক্তি আছে, এই মর্মে তারা তীব্র বিক্ষোভ শুরু করে। রাজ্য জুড়ে মন্ত্রী আর আইনসভার সদস্যদের ঘেরাওয়ের হুমকি দেওয়া হয়। ব্রিগেডের সমর্থনে এগিয়ে আসেন এনসিপি (ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি) নেতা জিতেন্দ্র আহাদ। এনসিপি প্রেসিডেন্ট শরদ পওয়ারও আহাদের পাশে দাঁড়ান, বলেন যে পুরন্দরে-কে কোনও মতেই ঐতিহাসিক বলা চলে না, তিনি নেহাত গালগল্প লেখেন। বোঝা যায়, পওয়ার শম্ভাজি ব্রিগেডের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে চান। তবে, খেয়াল করার মতো ব্যাপার, মাসখানেক কেটে গিয়েছে, কিন্তু ব্রিগেড কাউকেই এখনও পর্যন্ত ঘেরাও করেনি। তারা বোধহয় কেবল নিজেদের ক্ষমতার সীমা পরীক্ষা করে দেখছিল।
ব্রিগেডের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষোত্তম খেডেকর মরাঠা রাজনীতির অন্যতম প্রাণপুরুষ। মরাঠাদের জন্য সংরক্ষণের যে দাবির পিছনে পূর্বতন কংগ্রেস ও এনসিপি সরকার এত দিন সমর্থন জুগিয়ে এসেছে, তার পিছনেও অন্যতম প্রধান মস্তিষ্ক তিনিই। তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের সংরক্ষণের পাশাপাশি সরকারি চাকরি আর শিক্ষার ক্ষেত্রে এই মরাঠারাও সংরক্ষণের সুবিধা লাভ করে এসেছে রাজনীতির কেন্দ্রে থাকার সুবাদে। তবে ব্রিগেডের প্রধান পরিচয় এদের উদ্ভট সব ভাবনা এবং ভাঙচুর-অশান্তি-নৈরাজ্যের প্রবণতায়। ২০০৪ সালে পুনের ভান্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে প্রবল ভাঙচুর চালিয়েছিল এরা। সে বার তাদের বিক্ষোভের লক্ষ্য ছিল, শিবজির উপর মার্কিন স্কলার জেমস লেন-এর বই ‘শিবজি: হিন্দু কিং ইন ইসলামিক ইন্ডিয়া’ (২০০৩)। মহারাষ্ট্রে তখন কংগ্রেস-এনসিপি সরকারের শাসন চলছিল। তারা রাতারাতি বইটিকে রাজ্যে নিষিদ্ধ করে দেয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওই মার্কিন গবেষকের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ঘোষণা করেন, যদিও এই রকম ঘোষণা যে কতটা অর্থহীন, তা তাঁর অজানা ছিল না।
আর এ বার? ‘রাজা শিবজি বিষয়ে তথ্য বিকৃত করেছেন পুরন্দরে। বলেছেন, তাঁর মা জিজাবাই ও তাঁর অভিভাবক দাদোজি কোণ্ডদেব একই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। পুরন্দরের বই ‘রাজা শিব ছত্রপতি’ থেকেই লেন নির্লজ্জ ভাবে তথ্য জোগাড় করেছেন’: এই হল শম্ভাজি ব্রিগেডের পুণে শাখার প্রেসিডেন্ট সন্তোষ শিন্ডের বক্তব্য।
এনসিপি বিধায়ক জিতেন্দ্র আহাদ ব্রিগেডের বক্তব্যের সঙ্গে একমত, কেননা, পুরন্দরে নাকি লেন-এর বিতর্কিত বই সম্পর্কে একটি কথাও উচ্চারণ করেননি। ‘লেন-এর বইয়ে শিবাজি সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুতর সব তথ্যবিকৃতি আছে। তার অনেকটাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে পুরন্দরের লেখা থেকে নেওয়া। কেন তিনি লেন-এর বই নিয়ে বিন্দুমাত্র আপত্তি তোলেননি? এত ভুল তথ্য নিয়ে কোনও কথাই বলেননি?’ আহাদের প্রশ্ন। এনসিপি বিধায়ক অবশ্যই মনে রাখেননি যে অন্যান্য বেশ কিছু ইতিহাসবিদের সঙ্গে পুরন্দরেও জেমস লেন-এর বইটির নানা ভ্রান্তির সমালোচনা করেছেন, এবং তাঁর বক্তব্যের থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেছেন। পুরন্দরের ভ্রাতুষ্পুত্র, বিশ্বাস পুরন্দরে, তাঁর কাকার প্রতি এই ক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় একটি প্রয়োজনীয় কথা বলেছেন: ‘যে বই ষাট বছর আগে লেখা হয়েছে, হঠাৎ আজ কেন তার বিরুদ্ধে এত কথা? তেমন আপত্তিকর কিছু যদি এতে থাকত, তবে তো আগেই জানা যেত।’
যোদ্ধা রাজা শিবজি বিজাপুরের সেই সময়কার পতনোন্মুখ আদিলশাহি সুলতানি রাজত্বের থেকে বহু অংশ দখল করে একটি স্বতন্ত্র মরাঠা সাম্রাজ্যের সূচনা করেছিলেন। ১৬৭৪ সালে তিনি রায়গড়ের ছত্রপতি হিসাবে অভিষিক্ত হন। স্যর যদুনাথ সরকার প্রথম ইতিহাসবিদ যিনি ‘শিবজি অ্যান্ড হিজ টাইমস’ নামে এই মরাঠা রাজার প্রামাণ্য ইতিহাস লেখেন। মহারাষ্ট্রে আজকের কোনও রাজনৈতিক দলই কিন্তু এই অসাধারণ গবেষণাসমৃদ্ধ ইতিহাসের ধার ধারেন না, রাজ্য সরকারও এ বিষয়ে কখনও মুখ খোলে না। ফলত, কবে যে শিবজির জন্মবার্ষিকী পালন করা উচিত, সে বিষয়ে আজও মহারাষ্ট্রে কোনও ঐকমত্য নেই। যদুনাথ সরকারের মতে, শিবজির জন্মদিবস ৬ এপ্রিল ১৬২৭। কিন্তু মহারাষ্ট্র সরকার ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৬৩০ তারিখকেই শিবজির জন্মদিন হিসেবে পালন করে। পুরন্দরের নেতৃত্বে একটি কমিটি এই তারিখটি ধার্য করেছে। শিব সেনা অবশ্য হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী শিবজি-জন্মোৎসব করে থাকে, আর সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দিনটি এক এক বছর এক এক সময়ে ঠিক হয়, যেমন, এ বছর দিনটি ছিল ৮ মার্চ। বর্তমান বিজেপি সরকার স্বভাবতই শিব সেনার কথায় কান দিতে নারাজ। সুতরাং মহারাষ্ট্রে এ বছর শিবজির জন্মোৎসব পালিত হয়েছে দু’বার, দুটি আলাদা তারিখে। একটি সরকারি মত। অন্যটি শিব সেনার মত!
শম্ভাজি ব্রিগেডের উত্থানের সঙ্গে শিবজির মুসলিম-বিরোধী ইমেজ ক্রমশ ব্রাহ্মণ-বিরোধিতায় পর্যবসিত হয়েছে। সমস্ত অব্রাহ্মণকে মরাঠাদের নেতৃত্বে একত্র করার কাজে শিবজি আপাতত খুবই প্রাসঙ্গিক। এনসিপি শম্ভাজি ব্রিগেড-এ সঙ্গে এ ব্যাপারেও এককাট্টা। স্বভাবতই তার আগ্রহ মরাঠা-কুনবি ভোটব্যাঙ্ককে কব্জা করায়।
২০১০ সালে ব্রিগেড দাবি করেছিল, পুণের লাল মহল থেকে দাদোজি কোণ্ডদেবের মূর্তি সরিয়ে দেওয়া হোক, কেননা দাদোজি কেবল ব্রাহ্মণ ঐতিহাসিকদের কল্পিত কল্পনা মাত্র, ‘বাস্তব’ চরিত্র নন! এনসিপি শাসিত পুণে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন ব্রিগেডের এই দাবি শুনে বেশ উৎসাহ-সহকারে মূর্তিটি সরিয়েও দেয়। ব্রাহ্মণ-বিরোধী বলে শম্ভাজি ব্রিগেডের একটা প্রগতিশীল ইমেজ আছে। যাঁরা মনে করেন ১৯৯০ সালের পর শ্রেণি এবং শ্রেণি-সংগ্রাম বস্তুগুলি অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে, তাঁরা নিশ্চয়ই খেয়াল করবেন কী ভাবে সেই জায়গায় খাপে খাপে বসে গিয়েছে ধর্ম, জাতপাত ও আঞ্চলিক রাজনীতির কলকব্জা।
ইতিহাস যেহেতু বর্তমানের বিষয়বস্তু, শাসক দলের সর্বদাই একটা বাড়তি সুবিধে থাকে। শম্ভাজি ব্রিগেড ও এনসিপিকে বিলক্ষণ চটিয়ে গুজরাত ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন এ বছর লন্ডনে পুরন্দরের জমজমাট নাটক ‘জাণতা রাজা’-র দুটি প্রদর্শনীর আয়োজন করল, জুনের ২০ আর ২১-এ। জাঁকজমক করে দেখানো হল শিবজির সময়ে শত শত পদাতিক সৈন্য, বিরাট অশ্বারোহী বাহিনী, সারে সারে উট-হাতির সমারোহ কী ভাবে দেশের চালচিত্র পাল্টে দিচ্ছিল।
জয়ীরাই ইতিহাস লিখে রেখে যান, বলেছিলেন উইনস্টন চার্চিল। পরাজিতরা ইতিহাসের খেলায় হারতেই থাকে। কিন্তু তাই বলে চেষ্টা তো ছাড়া যায় না! মহারাষ্ট্রে পরাজিত পক্ষ এনসিপি, রাজ্য রাজনীতিতে আপাতত চতুর্থ বৃহত্তম দল, এই মুহূর্তে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ইতিহাসকে নিজেদের মতো করে লিখে যেতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy