—প্রতীকী চিত্র।
জিন্না আহমেদ তাঁহার পুত্রসন্তানের নামের সঙ্গে পদবি জুড়েন নাই। শর্মিলা ঘোষও সেই একই পথের পথিক। বিদ্যালয়ে ভর্তির সময় শর্মিলার মেয়ের নামের পাশে পদবির স্থানটিতে লেখা হইয়াছিল ‘মানবতা’। তাঁহারা এবং তাঁহাদের মতো আরও অনেকেই সন্তানের নামের অনুষঙ্গে ধর্মীয় পরিচয়কে বড় করিয়া দেখাইতে চাহেন না। অনেকেই দৈনন্দিন যাপনেও বিশেষ ধর্মীয় আচারগুলি পালনে আগ্রহী নহেন। মানবধর্মকেই সর্বোত্তম মানিয়াছেন। তাঁহারা ধর্ম-বর্ণের পরিচয়বাহী পদবিকে বিসর্জন দিবার পক্ষপাতী। এমন মানুষরা সংখ্যায় এখনও সামান্য, কিন্তু সংখ্যাটি বাড়িতেছে। এবং, পদবি বিসর্জন দেওয়ার পক্ষে অনেকেরই মূল তাগিদ আত্মরক্ষার, বা সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার।
তাগিদ কেন? উত্তরটি ভারতীয় সমাজব্যবস্থার মধ্যেই লুকাইয়া আছে। পদবি হইতে এক জনের যেমন ধর্ম পরিচয় জানা যায়, তেমনই জানা যায় তাঁহার জাতি, বর্ণ, এবং বংশ পরিচয়টিও। ভারতের মতো এমন বহুধাবিভক্ত দেশে ইহার প্রতিটির গুরুত্ব অপরিসীম। পদবি এখানে শুধুমাত্র এক জন ব্যক্তিমানুষের পরিচয় নহে। বরং ইহার ভিতর দিয়াই সমাজের তাঁহার স্থানটিও অলিখিত ভাবে নির্ধারিত হইয়া থাকে। এবং নির্ধারিত হয় তাঁহার সামাজিক সম্মান পাইবার অধিকারটিও। হিন্দু হইলে, উচ্চবর্ণ হইলে এবং কুলীন বংশের সন্তান (অবশ্যই পিতৃপরিচয়ের ভিত্তিতে— জন্ম দেওয়া ভিন্ন এই সমাজে সন্তানের পরিচয়ে মাতার অবদানের স্বীকৃতি যৎসামান্য) হইলে সমাজের উচ্চাসন এবং সর্বাধিক সম্মানটি সর্বাগ্রে তাঁহার জন্য বরাদ্দ হইবে। শুধুমাত্র একটি পদবির জোরেই তিনি বিনা আয়াসে অনেক কিছু পাইবার অধিকারী হইবেন। এমনকি অন্যায় করিলেও সমাজের একাংশ তাঁহার প্রতি ক্ষমাশীল হইবে। ভেদাভেদের এই প্রেক্ষিতই মূলত আলোকপ্রাপ্ত নাগরিককে পদবি অস্বীকার করিবার সাহস জোগাইতেছে। এবং ক্রমশ তাঁহাদের সংখ্যা যে বৃদ্ধি পাইতেছে, তাহার কারণ প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি এক ক্রমবর্ধমান অনাস্থা। যে পরিচয় সমাজের ভিতর এ-হেন বিভেদের জন্ম দিয়াছে, সেই পরিচয়ের প্রতি অনাস্থা।
লক্ষণীয়, সন্তানের পদবি বাদ দিয়াছেন যাঁহারা, তাঁহাদের অনেকেই অন্য ধর্মে বিবাহ করিয়াছেন। অভিজ্ঞতাটি মধুর নহে। ভারতের মতো দেশে অন্য ধর্ম বা জাতে বিবাহ-পরবর্তী জীবনে দম্পতিরা নানাবিধ সামাজিক হেনস্থার সম্মুখীন হন। কখনও প্রাণঘাতী আক্রমণের শিকারও হইতে হয়। সন্তানের নামে পদবি না জুড়িয়া তাহাকে এই তিক্ততার হাত হইতে বাঁচাইবার অভিপ্রায়টিও তাই গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ভাগ্য ভারতের, একবিংশ শতাব্দীর উনিশটি বৎসর অতিক্রম করিয়াও সে পদবি বিচারের হাত হইতে মুক্তি পাইল না। সময়ের বিচারে দেশ আধুনিক হইল, কিন্তু মানসিকতা পড়িয়া রহিল আলোকবর্ষ পিছনে। ধর্মীয় পরিচয়, জাতপাতের সঙ্কীর্ণতায় সে আকণ্ঠ নিমজ্জিত রহিল। মানুষ পরিচয়টি ক্রমশ দূরে সরিয়া পদবিসর্বস্বতাই প্রধান হইয়া উঠিল। প্রাচীনপন্থার শাসনে এই সঙ্কীর্ণতার অবসান হইবার নহে। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাহার শিকড় সমাজব্যবস্থার আরও গভীরে প্রবেশ করিতেছে। সামাজিক হিংসার অবসান ঘটাইতে হইলে তাই বিভেদের এই চিহ্নটি সর্বাগ্রে মুছিতে হইবে। পথ দেখানো শুরু হইয়াছে সবে, সেই পথে হাঁটিতে হইবে অনেক দূর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy