এ দেশের নির্বাচনী ঢক্কানিনাদে একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর চাপা পড়ে গেল। ৪ মে বেশির ভাগ দেশের বড় শহরগুলিতে বিজ্ঞানীরা আবার পথে নামলেন বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতাকে রক্ষা করতে। তিন বছর ধরে এই ‘মার্চ ফর সায়েন্স’ ঘটছে। যে শাসকরা সমাজের প্রগতির কথা বলেন, তাঁরা বিজ্ঞানের অগ্রগতির প্রয়োজন বুঝবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিক প্রত্যাশাটাই ধাক্কা খেয়েছে একুশ শতকে। তাই বিজ্ঞানীরা পথে নামতে বাধ্য হয়েছেন।
মানুষের অবিবেচক কর্মকাণ্ড প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপুল ক্ষতি করে চলেছে, কলকারখানাগুলো জলে ও বায়ুতে লাগাতার বিষ নিক্ষেপ করে চলেছে, প্লাস্টিক-বর্জ্যে নদীনালাসমুদ্র সব দূষিত, মানুষের লোভে জঙ্গল ধ্বংস হচ্ছে একের পর এক। রাষ্ট্রপুঞ্জের এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে আগামী অর্ধ শতকেই পৃথিবীর লক্ষাধিক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস মেশার ফলে পৃথিবী থেকে তাপরশ্মি বাইরে যেতে পারছে না। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। পৃথিবীর সহনক্ষমতা যথেষ্ট বেশি ঠিকই, কিন্তু অসীম নয়। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এখনই ব্যবস্থা না করলে মানুষের একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহটি বাসযোগ্য না-ও থাকতে পারে।
আর এখানেই সমস্যা। যে ব্যবস্থাই করা হোক না কেন, মুনাফা কিছু কমবেই। যে উৎপাদন ব্যবস্থার উদ্দেশ্যই হচ্ছে মুনাফা, সেখানে উৎপাদকরা তা মানবে কেন? তাই একের পর এক বৈঠকে গড়িমসি চলছিলই। এরই মধ্যে ট্রাম্প সাহেব বলে বসলেন পরিবেশ-দূষণ যে হচ্ছে, তাপমাত্রা যে বাড়ছে, তা তিনি মানেন না। জলবায়ু চুক্তিতে সই করতে অস্বীকার করলেন। আর, অর্থনৈতিক ভাবে বৃহত্তম দেশটিই যদি অংশীদার না-হয়, পরিবেশ রক্ষার কোনও প্রস্তাবই কার্যকর হতে পারে না। তাই মার্কিন বিজ্ঞানীরাই স্থির করলেন, লাগামহীন মুনাফা-লোভে লাগাম পরাতে জনতার দরবারে যাবেন। রাস্তায় নেমে প্রচার-প্রতিবাদ করবেন, বিজ্ঞানের সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই দেশের নীতি প্রণয়নের দাবি তুলবেন।
ঘটনা হল, বিশ্বের নানা উন্নয়নশীল দেশে তো বটেই, এমনকি আমেরিকা, জার্মানি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি উন্নত দেশেও বিজ্ঞান গবেষণার জন্য সরকারি অর্থবরাদ্দ তলানিতে এসে ঠেকেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্টের সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইত্যাদি আগের মতো বিজ্ঞান গবেষণায় অর্থ সাহায্য করতে পারছে না, কারণ তাদের বাজেট কমছে।
প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার প্রয়োজনীয় অর্থের একটা বড় অংশ আসে শিল্পসংস্থাগুলো থেকে। অর্থাৎ ব্যক্তিগত মালিকানাধীন কলকারখানার প্রয়োজনীয় গবেষণাও অনেকটা হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে, খরচ জোগান শিল্পপতিরা। তাতে শিল্পপতিদেরই খরচ কমে। গবেষণার পুরো কাঠামোটা তৈরি করতে হয় না, অথচ গবেষণালব্ধ ফল তাঁদেরই হাতে আসে। সেই শিল্পবিপ্লবের সময় থেকেই রাষ্ট্রনায়করা ও শিল্পপতিরা জানতেন, শিল্প ক্ষেত্রে দেশকে উন্নত করতে হলে, অন্য দেশকে টেক্কা দিতে হলে, শুধু প্রায়োগিক গবেষণাই নয়, মৌলিক গবেষণাকেও উৎসাহ দিতে হবে, কারণ আজকে যা মৌলিক গবেষণা, কাল তা-ই নতুন প্রযুক্তির দরজা খুলে দেয়। উপলব্ধিটা ছিল বলেই আজ যারা উন্নত দেশ বলে পরিচিত সে সব দেশে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি গবেষণা সরকারি ও বেসরকারি অর্থ সাহায্য পেয়ে এসেছে।
সেই পরিচিত চিত্রটা আজ পাল্টাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পাচ্ছেন না, যন্ত্রপাতি কিনতে পারছেন না, এমনকি গবেষক-ছাত্রদের মাইনেও দিতে পারছেন না। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, প্রায় সব উন্নত পুঁজিবাদী দেশেই চিত্রটা একই। হয়তো ভবিষ্যতে অর্থশাস্ত্রীরা গবেষণা করে দেখাবেন একটা বিশ্বব্যবস্থার সঙ্কট কত তীব্র হলে এমন আত্মঘাতী নীতি নেওয়া যেতে পারে। এটুকু বলা যায়, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইউরোপ-আমেরিকায় যে তীব্র ‘রিসেশন’ হয়েছিল, তখনও বিজ্ঞানপ্রযুক্তির অগ্রগতি এমন ধাক্কা খায়নি।
তাই ২০১৭ সালে আমেরিকার বিজ্ঞানীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের ডাক দিলেন, অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীরাও সাড়া দিলেন। বিজ্ঞানীদের উদ্যোগ হয়ে দাঁড়াল বিশ্বজোড়া ‘মার্চ ফর সায়েন্স’।
সমস্যাগুলো এ দেশে আরও তীব্র। এখানে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি গবেষণায় খরচ হয় জিডিপি’র মাত্র ০.৮ শতাংশ, আর অন্যান্য উন্নয়নশীল বা উন্নত দেশে তা তিন শতাংশের বেশি। বিজ্ঞান গবেষণায় দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যয়বরাদ্দ জিডিপির ৪.১৫ শতাংশ, জাপানের ৩.৪৭ শতাংশ। ভারতে শিক্ষাখাতে খরচ বরাদ্দ তিন শতাংশের কম, যেখানে অন্যান্য দেশে তা ৬ থেকে ১০ শতাংশ। শিক্ষাখাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খরচ করে জিডিপির ৬.৪ শতাংশ, নিউজ়িল্যান্ড ৬.৯ শতাংশ, উত্তর কোরিয়া ৬.৭ শতাংশ, ইজ়রায়েল ৬.৫ শতাংশ, কিউবা ১২.৪ শতাংশ। ফলে শিক্ষা ও বিজ্ঞান দুই ক্ষেত্রেই ভারত অনেক পিছিয়ে।
মুশকিল হল, সংবিধানের ৫১এ ধারা অনুযায়ী বিজ্ঞানমনস্কতার চর্চা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হলেও এ দেশের শিক্ষিত মানুষ নানা কুসংস্কারের শিকার। তার উপর সরকারি নেতা-মন্ত্রীরা পাল্লা দিয়ে অবৈজ্ঞানিক ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে চলেছেন। শিক্ষা-প্রতিমন্ত্রী বলেছেন ডারউইন তত্ত্ব ভুল, কারণ কেউ কোনও বাঁদরকে মানুষ হয়ে যেতে দেখেননি। বিজ্ঞানপ্রযুক্তি মন্ত্রী বলেছেন আইনস্টাইন কী এমন নতুন কথা বলেছেন, এর থেকে ভাল তত্ত্ব তো বেদেই ছিল। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, মহাভারতের যুগে নিশ্চয় ইন্টারনেট ছিল, নয়তো ধৃতরাষ্ট্র কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের লাইভ-স্ট্রিমিং পেলেন কী ভাবে। বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চ থেকেই এক জন বললেন বেদের যুগে এরোপ্লেন ছিল। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিধান দিলেন প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারি অবশ্যই ছিল, নয়তো গণেশের ধড়ে হাতির মাথাটা বসানো হল কী ভাবে?
ভারতের বিজ্ঞানীরা এর প্রতিবাদ করছেন। নির্বাচনের জন্য ৪ মে এ দেশে ‘মার্চ ফর সায়েন্স’ করা যায়নি বটে, এ সব চুকে গেলে ৯ অগস্ট এ দেশে তাঁরা পথে নামবেন।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy