Advertisement
১৩ নভেম্বর ২০২৪
Science

বৃহৎ বিড়ম্বনা

বিজ্ঞান গবেষণা এক্ষণে বৃহদাকার ধারণ করিয়াছে। কোনও সাফল্যই ইদানীং একক কৃতিত্বে অর্জন করা যায় না। 

শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২০ ০১:১৬
Share: Save:

এখন বিজ্ঞান গবেষণা বৃহৎ উদ্যোগে পরিণত। সেই কাল গিয়াছে, যখন একাকী সাধনায় ব্রতী হওয়া যাইত, সিদ্ধিলাভও করা যাইত। এক্ষণে পরিস্থিতি পরিবর্তিত। আজিকার কালে কোনও অনুসন্ধান আর নিভৃত চর্চার বিষয় নহে। ইহার বৃহত্তম উদাহরণ করোনাভাইরাস সংক্রান্ত গবেষণা। ভাইরাসটি যে হেতু অতিমারির রূপ ধারণ করিয়াছে, সেই কারণে তাহার স্বরূপ উদ্ঘাটনে এবং প্রতিষেধক আবিষ্কারে বিশ্বের বহু দেশে ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানীগণ প্রচেষ্টায় রত। অনুমান করা যায়, সাফল্যের বরমাল্যটি একক ভাবে কাহারও নহে, বহু বিজ্ঞানীর একসঙ্গে জুটিবে। সাফল্যের স্বীকৃতি যে হেতু পুরস্কার, সুতরাং তাহার বিষয়ও এই প্রসঙ্গে আসিয়া পড়ে। পদার্থবিদ্যায় ইদানীং কালে সবচেয়ে বড় সাফল্য আলবার্ট আইনস্টাইন কথিত গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ বা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্তকরণ। ১৯১৬ সালে আইনস্টাইন জেনারেল রিলেটিভিটি তত্ত্ব প্রকাশ করিলে তত্ত্বটি হইতে আসিয়া পড়ে উক্ত তরঙ্গ। একশত বৎসর বহু বিজ্ঞানী ওই তরঙ্গ শনাক্ত করিতে পারেন নাই। অবশেষে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে উক্ত তরঙ্গ— শূন্যস্থানের হাপরের ন্যায় সঙ্কোচন এবং প্রসারণ— শনাক্ত হয়। সাফল্য এত বৃহৎ যে, এক বৎসরের মধ্যে উহার জন্য বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠ শিরোপা নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হয়। যে বিজ্ঞানীগণ সাফল্য অর্জন করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের তিন নেতা রাইনার ওয়েইস, ব্যারি বারিশ এবং কিপ থর্ন পুরস্কারটি পান। উহাদের মধ্যে দুই জন— ওয়েইস এবং থর্ন— এবং রোনাল্ড ড্রেভারকে ধনকুবের ইউরি মিলনার, মার্ক জ়াকারবার্গ এবং অ্যান ওজসিকি-প্রবর্তিত ‘স্পেশ্যাল ব্রেক থ্রু প্রাইজ়’-ও দেওয়া হয়। লক্ষণীয়, উক্ত তিন জনের পাশাপাশি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্তকরণে যে ১,০১২ জন গবেষক যুক্ত ছিলেন, তাঁহাদের প্রত্যেককে ‘ব্রেক থ্রু প্রাইজ়’-এ ভূষিত করা হয়। কুড়ি লক্ষ ডলার অর্থ তাঁহাদের মধ্যে বণ্টিত হয়। ইহাদের মধ্যে প্রচুর ভারতীয় গবেষকও ছিলেন। উক্ত ১,০১২ জন গবেষককে পুরস্কার প্রদানে একটি বার্তা নিহিত ছিল। বার্তাটি এই যে, বিজ্ঞান গবেষণা এক্ষণে বৃহদাকার ধারণ করিয়াছে। কোনও সাফল্যই ইদানীং একক কৃতিত্বে অর্জন করা যায় না।

বিজ্ঞানী রোজ়ালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের জন্মশতবর্ষে উক্ত বার্তাটি স্মরণীয়। গত শতাব্দীতে জীববিদ্যায় সর্বশ্রেষ্ঠ সাফল্য নিঃসন্দেহে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা ডিএনএ-র গঠন আবিষ্কার। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি যে এক্স-রে ডিফ্র্যাকশন ছবি তোলেন, তাহা উক্ত আবিষ্কারের পথ প্রশস্ত করে। ওই ছবি দেখিয়াই বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসন ডিএনএ-র যুগ্ম সর্পিল গঠনের আঁচ পান। তিনি তাঁহার সহকর্মী ফ্রান্সিস ক্রিক-কে সেই তথ্য জানাইলে তাঁহারা যুগলে ওই রূপ গঠন আবিষ্কারে ব্রতী হন। ১৯৬২ সালে ডিএনএ-র গঠন আবিষ্কারে সাফল্যের জন্য তিন বিজ্ঞানীকে চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই তিন জন হইলেন ওয়াটসন, ক্রিক এবং মরিস উইলকিন্স। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে ডিম্বাশয়ের ক্যানসার রোগে ফ্রাঙ্কলিন প্রয়াত হন। এক বিষয়ে তিন জনের বেশি পণ্ডিতকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার রীতি নাই। ফ্রাঙ্কলিন অকালে প্রয়াত না হইলে পুরস্কার প্রদান করিতে গিয়া নোবেল কমিটি বিড়ম্বনায় পড়িতেন। সম্ভবত রীতিভঙ্গ করিতেন না। বরং সত্যের অপলাপ ঘটাইয়া কৃতিত্বের স্বীকৃতি দিতে গিয়া কৃপণ হইতেন। মোট কথা, বিষয়টি মোটে সুখকর হইত না।

ফ্রাঙ্কলিন প্রসঙ্গে উক্ত এক্স-রে ডিফ্র্যাকশন ছবিটি সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত হইলেও, তিনি বহুবিধ গবেষণায় লিপ্ত ছিলেন। জীববিদ্যা, রসায়ন, এমনকি পদার্থবিজ্ঞানের নানা বিষয়ে তিনি অনুসন্ধান করিয়াছিলেন। কয়লা নিরেট বস্তু নহে, তন্মধ্যে ফাঁক-ফোকর আছে। ফ্রাঙ্কলিনের কয়লা বা কার্বন লইয়া গবেষণা ওই ফাঁক-ফোকর সন্ধানে ব্যাপৃত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে ব্রিটিশ সৈন্যগণ জার্মানির ব্যবহৃত বিষ গ্যাসের আক্রমণ হইতে বাঁচিতে যে মুখোশ পরিত, তাহাতে চারকোল ফিল্টার থাকিত। উক্ত ফিল্টার নির্মাণে ফ্রাঙ্কলিনের কয়লা-সংক্রান্ত গবেষণা কাজে লাগে। অতীতের কথা বাদ দিয়া বর্তমানের দিকে তাকানো গেলে আমরা দেখিতে পাইব ফ্রাঙ্কলিনের গবেষণার সুফল আজিও ফলিতেছে। করোনাভাইরাসের স্বরূপ বুঝিতে গবেষকগণ বর্তমানে যে ডিএনএ বিশ্লেষণ কিংবা এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির সাহায্য লইতেছেন, তাহাও ফ্রাঙ্কলিনের গবেষণার অনুসারী। হায়, এ হেন বিজ্ঞানীর সাফল্যও পুরস্কৃত হয় নাই। ইহাকে বিজ্ঞানের বৃহদায়নের কুফল ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়?

অন্য বিষয়গুলি:

Science Research Coronavirus Coronavirus Vaccine
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE