মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে মেয়ে, আর ক’দিন পরেই রেজ়াল্ট। মা দুপুরে ফিরে দেখেন ঘরে শিকল তোলা। ‘‘সাত দিন মেয়েটা বাড়ি ফেরেনি। বুকের মধ্যে কী যে হচ্ছে, কী বলব’’, কান্নায় বিকৃত মুখ আঁচলে ঢাকলেন মহিলা। খানিক দূরে নিশ্চুপ বসে আর এক মহিলা। শাড়ির ঘোমটার ঘেরাটোপে অন্ধকার মুখ। তাঁর মেয়ে প্রেমিকের সঙ্গে ঘর ছেড়েছিল আঠারো না হতেই। তিন মাস পরে তার দেহ মিলেছে। মহিলাদের রায়, মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছিল শ্বশুরবাড়ির লোকে। ‘‘খাট-আলমারি চেয়েছিল। খাট দেব বলেছিলাম। আগেই মেরে ফেলল।’’
আর এক মহিলার মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে, তার কোনও সাধ অপূর্ণ রাখেননি। আজ সে বলছে, বিয়ে না দিলে গলায় দড়ি দেব। ‘‘একটু বুঝিয়ে বলুন। ওই ছেলের চালচুলো নেই, পড়াশোনা নেই, ওকে কেউ বিয়ে করে?’’ বলতেই তাঁর পাশে বসা আর এক মা ভেঙে পড়লেন। তাঁর মেয়েও উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছিল, ফোনে কথা বলত একটি ছেলের সঙ্গে। ‘‘এক দিন বলল, মা, সুমন আর আমাকে ফোন করে না। বললাম, ক’দিন অপেক্ষা কর। তা এক দিন বাড়ি ফিরে দেখি, মেয়ে ঝুলছে।’’ অনেকে চোখে কাপড় চাপা দিলেন। ‘‘মেয়েগুলো মরে যাচ্ছে, দিদি। আমরা শুধু দেখে যাচ্ছি।’’
নাবালিকা বিবাহের গড়পড়তা গল্পটা এই রকম: বাপ-মা জোর করে বিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটি কারও সাহায্যে তা রুখে দিচ্ছে। সাবেকি সংসারের এঁদো অন্ধকার থেকে সক্ষমতার আলোকবৃত্তে উত্তরণের গল্প। রাষ্ট্রপোষিত, এনজিও-ঘোষিত চিত্রনাট্য। এ ছবি অসত্য নয়। কিন্তু অন্য ছবিও আছে। মেয়ে নিজেই বিয়ে করতে চায়, বাধা পেলে বাড়ি ছাড়ে। ‘‘এমন যেন আজকাল বেড়ে যাচ্ছে’’, বললেন মায়েরা। কেবল তাঁরা কেন, সমীক্ষাও তাই বলছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ কন্যাশ্রী প্রকল্পের মূল্যায়ন করেছিল। দেখা গিয়েছে, নাবালিকা বিয়ের সংখ্যা মোটের উপর কমেছে, কারণ বাবা-মা বিয়ে দিচ্ছেন অনেকটাই কম। কিন্তু বেড়েছে ‘সেল্ফ-ইনিশিয়েটেড ম্যারেজ’ বা স্বেচ্ছাবিবাহ। ‘‘এরা ভয় পাচ্ছে, আঠারো বছর হয়ে গেলে বাবা-মা তাঁদের পছন্দের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেবে’’, বলছেন সমীক্ষক-শিক্ষক অরিজিতা দত্ত।
কিসের এত তাড়া? বারুইপুরের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার এক তলায় অশ্রুমতী মায়েরা বসে আছেন, দোতলায় তাঁদের কিশোরী মেয়েদের চোখে ঝরছে আগুন। পনিটেল আর দুই-বিনুনিদের কলস্বরে নালিশ, ‘‘বড়রাই তো বিয়ে-বিয়ে করে। মাধ্যমিক পাশ করো, যাতে ভাল বিয়ে হয়। কলেজ পাশ করো, যাতে ভাল বিয়ে হয়। চাকরি করো, যাতে ভাল বিয়ে হয়। জন্মেছি যেন বিয়ে করার জন্য। তাই তো বাচ্চা মেয়েরা বলে, বিয়ে করতেই হলে এখনই করি।’’
কিন্তু পালিয়ে বিয়ে করে যে মার খেতে হচ্ছে? ‘‘বেশি বয়সে বিয়ে হলে কি মার খেতে হচ্ছে না?’’ ‘‘বাবার ঘর নইলে শ্বশুরঘর। মেয়েরা যেন যাযাবর।’’
কী আশ্চর্য! ‘অপরত্ব’ বা otherness-এর যে ধারণা সমাজতত্ত্বে ব্যবহার করা হয় ক্ষমতাহীন গোষ্ঠীকে বোঝাতে (কৃষ্ণাঙ্গ, নিম্নবর্ণ), কী করে এই মেয়েরা তা বুঝে গেল? পাঠ্য যা শেখায়, জীবন ওদের তা শিখিয়ে দিয়েছে। ‘ভাল করে পড়ো’, এই অনুজ্ঞায় যে ছলনাটুকু আছে, তা ওরা বোঝে। স্কুলের শিক্ষা তার জন্য আকাশে ডানা মেলার প্রস্তুতি নয়। অন্য একটা খাঁচায় পুরে দেওয়ার তোড়জোড়। বিদ্রোহ আসে প্রেমের বেশে। কিন্তু মুক্তি কই? ‘‘বিয়ের আগে ছেলেরা প্রেমিক। আর হাজ়ব্যান্ড হলেই হয়ে যায় প্রভু’’, অভিমান করে বলল শ্রেয়া রায়। যতই পড়ো, চাকরি করো, পণ না দিলে মেয়েদের বিয়ে হয় না, নালিশ করল সনিয়া দণ্ডপত, নাসিমা খাতুন, সুস্মিতা সিপাইরা। কী করা যায় তা হলে? প্রশ্ন করতে উল্টে ওরা প্রশ্ন করল, এমন একটা কোর্স করা যায় না, যাতে শেখানো হবে মেয়ে আর পুরুষ সমান-সমান?
এমন একটা কোর্স তৈরি করা হয়েছিল— জীবনশৈলী শিক্ষা। শিক্ষকরা মেনে নেননি। এক প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী বিধানসভায় ঘোষণা করেছিলেন ২০১২ সালে— ওই পাঠ পড়ানো হবে না।
তবু প্রশ্নটা রাখা চাই শিক্ষকদের কাছে। দশ-বারো বছর স্কুলে পড়ার পরেও মেয়েরা নিজের শরীর-মনে অন্যের দখলদারিকে মেনে নিয়ে গ্লানিময় জীবন কাটানো ছাড়া উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। আর ছেলেরা বিকৃত, পীড়ন-সর্বস্ব সম্পর্কের বাইরে আনন্দময় সম্পর্কের সন্ধান পাচ্ছে না। এতে কি স্কুলের কোনও দায় নেই? যে প্রলোভন, যে চাপ (‘তুই রাজি না হলে আমি সুইসাইড করব’) থেকে একটা মেয়ে পড়া ছাড়তে চায়, তাকে মোকাবিলার শিক্ষা স্কুল কি দিতে পারত না? প্রেম-যৌনতা-লিঙ্গসাম্যকে ‘আউট অব দ্য সিলেবাস’ করে দিয়েই দায় ঝেড়ে ফেলা যায়? শিক্ষকরা বলবেন, ইংরেজি-অঙ্কই শেখানো যাচ্ছে না, আবার যৌনশিক্ষা! বোঝার উপর শাকের আঁটি। কিন্তু এই মেয়েদের পাশে দাঁড়ালে দেখা যাচ্ছে, এ আসলে তাদের শিক্ষারই শর্ত। সপ্তম শ্রেণি থেকে জীবনশৈলীর ক্লাস করলে হয়তো দশম শ্রেণির মেয়ে বিয়ের লোভে ঘর ছাড়ত না, দ্বাদশ শ্রেণি প্রেমিকের প্রত্যাখ্যানে গলায় দড়ি দিত না। ওরা স্কুলেই থাকত। বেঁচে থাকলে তবে না পড়বে মেয়েরা।
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy