Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

‘সাজানো সিমপ্যাথি’

গো ড়ায় আমি সরকারি, তাতে কী হয়েছে, শেষ অবধি আমি কৌঁসুলি তো! ভুলো না বাপু, কথাটা কাউন্সেল থেকে এসেছে। সরকার কী বললে ভাল হয়, কীসে তার ইমেজ তকতকায়, তার চেয়ে ঢের জরুরি: মামলাটার পিচে এখন কোন গুডলেংথ দরকার।

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০২
Share: Save:

গো ড়ায় আমি সরকারি, তাতে কী হয়েছে, শেষ অবধি আমি কৌঁসুলি তো! ভুলো না বাপু, কথাটা কাউন্সেল থেকে এসেছে। সরকার কী বললে ভাল হয়, কীসে তার ইমেজ তকতকায়, তার চেয়ে ঢের জরুরি: মামলাটার পিচে এখন কোন গুডলেংথ দরকার। দেখলাম, যে দিকে ব্যাপার গড়াচ্ছে, বেচারারা ফাঁসিটাসি না চলে যায়! দাপিয়ে বললাম, মিনিমাম শাস্তিটা দিন। ব্যস, হইচই শুরু। তাতে কিছু এসে যায় না, কারণ এই যুগের যদি একখান থান প্রবণতা থাকে, তা হল বাড়াবাড়ি করা। যেখানে সাত দরকার, সেখানে সাতাত্তর না হানলে এদের পিৎজা হজম হয় না। এমন একটা ভাব দেখানো হচ্ছে, যেন আমি ধর্ষণ সাপোর্ট করি। যেন আমিই বলেছিলাম ‘সাজানো ঘটনা’। আরে বাবা, ইমোশনের ডাবায় সাঁতার কাটলে ন্যায় বোঝা যায় না, চোখে কান্না আর নাকে সিকনি এসে গেলে বিচার ঝাপসা হয়ে যায়।

মামলাটা নিয়ে আসলে লোকের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর সব বায়াস কিলবিল। যেন ছেলেগুলোকে শাস্তি দিলে মুখ্যমন্ত্রীর ওপর বেশ একটা শোধ তোলা হবে। এমনিতেই যে-ই শাসন করুক, তার ওপর পশ্চিমবাংলার লোক হিউজ খেরে থাকে। কিছুই না, চাদ্দিকের ঘোর অব্যবস্থা, অপদার্থতা, আর সে জন্য নেতাগুলোর ক্ষমা চাওয়া তো দূরস্থান, উঠতে-বসতে ঔদ্ধত্যের থাপ্পড়— সব মিলিয়ে, রোজকার নারকীয় জ্যামের মতো, ধৈর্য আর মেজাজকে খিঁচড়ে দেয়। মনে হয়, এই অহরহ সিনেমা আর্টিস্টদের কাঁধ ঘেঁষে গলগলে পোজ দেওয়া বজ্জাতগুলোকে ভোট দিয়ে আনলাম, ব্যাটাদের মাথায় ডজনখানেক বাজ পড়ুক। এই আকাঙ্ক্ষা অন্যায় নয়, কিন্তু এর ওপর ভর করে একটা মামলাকে রিভেঞ্জ-নাইট্য করে তুললে হবে না। এটা একটা ধর্ষণের মামলা— সেই ক্লোজ-আপে দেখতে হবে। হঠাৎ সরকারের মস্তানি ও মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণের ভেনডেটা হিসেবে এটাকে নিয়ে নিলে, অনাবশ্যক লং শটের ফ্রেমে ক্রোধ-চালাচালি করলে, টিভি চ্যানেলের সুবিধে, কিন্তু যুক্তির ঘরে ঢ্যাঁড়া পড়ে একাক্কার।

সাধারণ মানুষের সর্বাধিক ঝামেলা: সারা ক্ষণ চোখের বদলে চোখ ওপড়ানোর জন্য দাঁত কশকশ করছে। স্বাভাবিক, ফ্রাস্টু পাবলিক তো। বাড়িওলার ঝাড়, বসের কানমলা, তার ওপর সেক্সও হচ্ছে না বছরের পর বছর। সঙ্গে আছে সিরিয়ালগুলো, অনবরত ননদের চচ্চড়িতে সেঁকো বিষ স্প্রে করার নিদান হাঁকছে। এই সব মিলিয়ে জনতার সিধে সিদ্ধান্ত: আইনসম্মত গণধোলাই দেখব। মুশকিল হল, ভিকটিম কষ্ট পাচ্ছে বলেই অপরাধীর গলায় শেকল পেঁচিয়ে রাজপথে ঘোরাব, এই তত্ত্বে প্রতিশোধের পরোটা ফুলেফেঁপে ওঠে বটে, কিন্তু বিচারের আধুনিকতা টোল খায়, মধ্যযুগের লৌহশাসকের সিল্যুয়েট আদালতের পেছনে লম্বা হয়ে শোয়। ও দিকে দেখুন, ফাঁসির রায় হলেই এক দল বিবেকের ড্রেস পরা আঁতেল ‘মৃত্যুদণ্ড চলছে না চলবে না’ রবে টক-শো আর তেতো-নিবন্ধের বাজারে ঘাই মেরে ওঠে। তা বাপু, সে বেলায় যদি ক্ষমার হোস-পাইপের তোড়ে অপরাধের নর্দমা সাফ করার মহৎ প্রকল্প নাও, ধর্ষকের কারাদণ্ড কমাবার বেলায় সেই ক্ষমার নির্মল ফ্লো চিনতে নারছ কেন? কেন বুঝছ না, ক্ষমা এমন হাফ-হার্টেড হতে পারে না যে শুধু কোতলকে রদ করবে, আর কারাদণ্ডের বেলায় শিস দিয়ে বলবে, চলুক! সেটাই তো সত্যি সভ্য সমাজ, যেখানে ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষিতা কাঁদে সমান আঘাতে, হায় কেন ওকে ঘানি টানতে হবে, কোমরে যে খিঁচ লেগে যাবে ভগবান!

এখন সরকার আমাকে অপসারণ করছে। করুক, এই ঘটনায় একখান কমেন্ট করে অ্যায়সা মুখ পুড়েছিল, এখন ভোটের ভোরবেলায় যদি কাউকে বলির পাঁঠা করে তার কিছুমাত্র ‘কন্ট্রোল জেড’ করা যায়, সুবিধে। এখন হয়তো দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে, সরকার এ সব ন্যক্কারজনক ঘটনার এতই বুমবুম-বিরুদ্ধে, এদের চোখ ছিঁড়ে নেওয়া হলে মহাকরণে নলেন গুড়ের সন্দেশ বিলি হবে। রাজনীতি এ রকমই জিনিস, যে মহারত্নরা সে দিন ‘একলা মেয়ে রাতদুপুর অবধি কাঁকাল দুলিয়ে মদ গিলে ব্যাটাছেলের গায়ে ঢলে ঢলে পার্টি করছিল!’ বলে তারিয়ে তারিয়ে টিপ্পুনি কেটেছিলেন, এখন তাঁরাই ‘আহা গো মেয়েটার আত্মার শান্তির নিমিত্ত চুরাশি বচ্ছর জেল দিলে না’ বলে কেঁদে ককিয়ে হেঁচকি তুলে মিনারেল ওয়াটার চাইবেন। এইগুলো হল ‘সাজানো সিমপ্যাথি’। এর মূলে ভোট-ক্যাংলামি আর ধ্যাবড়া ধাস্টামি ছাড়া কিস্যু নেই।

পাবলিকও একই। একদম এক। যারা আমার অপসারণে আনন্দ পেয়েছে, সম্ভবত তারা ‘মাঝরাতে বাইরে ফুত্তি করা মেয়েদের শিক্ষা হওয়া দরকার’ ভেবেও সমান আনন্দই পায়। আর মিডিয়ার তো কাজই হচ্ছে পাবলিকের চাহিদামত আইটেম নাম্বার নির্মাণ। কিন্তু মুশকিল হল, অশিক্ষা আর মেলোড্রামা মিলিয়ে অনেকটা জোরে চেঁচাতে পারলেই আইন বিগড়ে যায় না। আইনের চোখে, যে কাজটা করেছে, আর যে সাহায্য করেছে, তারা একই ডিগ্রির অপরাধী নয়। যদি বলো, সেও তো সমর্থন করেছে, মজা মেরেছে, আমি বলব, হক কথা, তা হলে যে লোকটা খোলা বাজারে খুন করছিল, আর যারা সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোড়ালি চুলকোতে চুলকোতে দেখছিল, এক বারও বাধা দিতে এগিয়ে যায়নি বরং সেলফোনে তুলে রেখেছে অফিসময় দেখাবে বলে— সক্কলের সমান জেল হলে আপনারা রাজি তো? মহিলাকে যখন গাছের সঙ্গে বেঁধে পেটানি চলে, টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে ঝোপের পাশে গণধর্ষণ চলে, আর গোটা গ্রাম তার মরণচিৎকার শুনতে শুনতে জল তোলে বাসন মাজে মুচমুচ পাঁপড় খায়— পুরো গ্রামের সব্বাইকে ফাঁসিতে ঝোলালে সবাই একমত তো? তখন অ্যাক্টিভ আর প্যাসিভের, মূল পান্ডা আর অ্যাসিস্ট্যান্টের, ‘যে করে’ আর ‘যে সহে’-র কোটেশন মেপে দহন ভাগ করে নেবে কি উত্তাল জনগণ?

অন্য বিষয়গুলি:

sarbani roy park street rape case
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE