মুখে নেই মাস্ক
করোনা সংক্রমণ রোধে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি এসএমএস। তবে এসএমএসের অর্থ এখানে মোবাইলে বার্তা পাঠানো নয়। এখানে তার অর্থ, স্যানিটাইজ়েশন, মাস্ক, সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং।
চিকিৎসকদের মতে, এই ‘এসএমএস’-এর তিনটি সূচক সমান ভাবে পালিত হলেই তবেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে পুরোপুরি বাঁচা সম্ভব। কোনও একটি বা দুটিতে খামতি থাকলে সংক্রমণ এড়ানো যাবে না। হাজার হাজার পুজো মণ্ডপে ভিড় হবেই। চেষ্টা করলেও পুজোর ভিড়ে তিনটি সূচক সম্পূর্ণভাবে মেনে চলা কঠিন। এই কারণেই পুজোর পর সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন রাজ্যের চিকিৎসক মহলের একাংশ। সহমত জেলা স্বাস্থ্য কর্তাদের অনেকেই। তাঁদের মত, কেরলেওনাম উৎসব বা মহারাষ্ট্রের গণেশ পুজোর পর সংক্রমণের পরিস্থিতি অত্যন্ত সঙ্কটজনক হয়ে উঠেছে। একই উৎসাহে দুর্গাপুজো পালিত হলে এবং প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন করা না হলে ছবিটা একই রকম ভয়াবহ হতে পারে।
চিকিৎসকদের কথায়, করোনাভাইরাস ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়ায়। সংক্রমণ এড়াতে এলাকা স্যানিটাইজ় করা, প্রত্যেকের মাস্ক পরা ও পারস্পরিক দূরত্ববিধি মেনে চলা জরুরি। এই সবকটি সুরক্ষাবিধি একসঙ্গে পালন করলে তবেই সংক্রমণ রোখা যায়। পুজোর ভিড়ে সেটা কতটা সম্ভব সেই প্রশ্ন থাকেই। কারণ নতুন পোশাক পরে সকলেই মাস্কে মুখ ঢেকে পথে নামবেন সেটা আশা করা যাচ্ছে না। পুজোর আগেই বাজারে যা ভিড় দেখা যাচ্ছে সেই ভিড় উদ্বেগ আরও বাড়াচ্ছে। রাস্তায় পুজোর বাজার করতে বেরিয়ে পড়া অনেকের মুখেই মাস্কের দেখা মিলছে না। তাই চিকিৎসকদের অনেকের আশঙ্কা যদিও বা মণ্ডপে ঢোকার সময় নিয়ম মেনে মুখে মাস্ক থাকে, মণ্ডপ থেকে বেরিয়েই অধিকাংশের মাস্ক জায়গা পাবে তাঁদের হাতে, থুতনি বা গলায়। ভিড়ে দূরত্ব বিধিই বা কতটা মানা যাবে তা নিয়েও সন্দেহ আছে। সব সময় প্রতিটি মণ্ডপ স্যানিটাইজ় করা হবে এমনটা বাস্তবোচিত নয়। তা যতই সরকারি নির্দেশিকা থাকুক, সংক্রমণ ছড়ানোর ভয় মারাত্মক ভাবেই রয়েছে।
সে কথা মাথায় রেখে চিকিৎসকদের পরামর্শ, আবেগ দূরে সরিয়ে পারলে এ বার পুজোয় অন্তত বাড়িতে থাকুন বা কাছাকাছি পুজো দেখুন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বা টিভিতেই যতটা সম্ভব ততটা পুজো দেখা যেতে পারে। ভিড়ে কোনও মতেই যাওয়া উচিত না। এই স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে বিপদ। রামপুরহাট স্বাস্থ্য জেলার সিএমওএইচ রবীন্দ্রনাথ প্রধান এবং বীরভূম স্বাস্থ্য জেলার সিএমওএইচ হিমাদ্রি আড়ি, দু’জনেই বলছেন, ‘‘সংক্রমণ এড়াতে যে সব বিধিনিষেধ আছে সেগুলো না মানলে সংক্রমণ বাড়বেই।’’
জেলা হাসপাতালের এক চিকিৎসক সমীরকান্ত দত্ত বলছেন, ‘‘সুরক্ষা ব্যবস্থার তিনটি নিয়মের মধ্যে একটি একটি বা দু’টি না মানলেই বিপদ। পুজোর ভিড়ে সেই সম্ভাবনা প্রবল। কতগুলি পাউরুটির টুকরো পরপর দাঁড় করিয়ে বিষয়টি বোঝানো যায়। স্যনিটাইজ়েশনে যে অংশে ছিদ্র, সোশ্যাল ডিস্টেন্স-এ সেই খামতি ঢাকবে। আরও কোনও ক্রটি থেকে থাকলে সেটা ঢাকবে মাস্ক পরলে।’’ কিন্তু হাজার হাজার পুজো মণ্ডপে সত্যিই যদি প্রচুর সংখ্যক মানুষের জমায়েত হয়, কী ভাবে সুরক্ষাবিধি মানা সম্ভব, প্রশ্ন থাকছেই।
প্রশাসনের কর্তারাও মনে করছেন, একগুচ্ছ সরকারি নির্দেশিকা দেওয়া হলেও ২৪০০টিরও বেশি বেশি বারোয়ারি পুজো মণ্ডপে চলমান ভিড়কে সে কথা বোঝানো সম্ভব নয়। সেই আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে ইতিমধ্যেই কোভিড পজ়িটিভ রোগীর জন্য শয্যা বাড়ানোর কথা ভেবেছেন বীরভূমের দুই স্বাস্থ্য জেলার স্বাস্থ্য কর্তারা। তাঁদের মতে, পুজোর ভিড় এবং মেলামেশার ফলে বাড়তে পারে করোনা। ফলে পুজোর পর আচমকা সংক্রমণ বেড়ে যাওযার যে আশঙ্কা চিকিৎসক মহল করছেন, তাতে বহু রোগীর ঠাঁই মিলবে না হাসপাতালে। জেলার দুটি স্বাস্থ্যজেলায় থাকা দুটি কোভিড হাসপাতালের ১৪০টি শয্যার বাইরে দুটি সেফ হোমকে সঙ্গটজনক কোভিড রোগীর চিকিৎসার পরিকাঠামো গড়ে তোলার ভাবনা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আশঙ্কা অনুযায়ী পুজো পরবর্তী সংক্রমণ দ্রুত ছড়ালে ওই সংখ্যক শয্যা পূরণ হওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা হতে পারে বলে মনে করিয়ে দিচ্ছেন চিকিৎসকদের অনেকেই।
এমন ভাবনার পিছনে অবশ্য সঙ্গত যুক্তিও রয়েছে। সুস্থতার হার স্বস্তি দিলেও করোনা সংক্রমণের ছবিটা দিন দিন খারাপ হচ্ছে জেলায়। ইতিমধ্যেই জেলায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ হাজারে পৌঁছে গিয়েছে। আমজনতা তো আছেনই, কোভিডের থেকে রেহাই পাননি সরকারি আমলা, পুলিশ চিকিৎসক থেকে স্বাস্থ্যকর্মী কেউ-ই। জেলায় মৃত্যু হয়েছে ৪০ জনের। কিন্তু আনলক প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর দু’মাস যেতে না যেতে যেতেই মানুষের মধ্যে দূরত্ববিধি বজায় না রাখা, মাস্ক না পরার প্রবণতা ক্রমশ বেড়েছে। রাস্তায় বেরোলেই দেখা যাচ্ছে বর্তমানে অধিকাংশ মানুষই মাস্ক পরছেন না। মাস্ক পরার পরামর্শ দিতে গিয়ে উল্টে হেনস্থার শিকারও হতে হচ্ছে সচেতন নাগরিক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের। আরও একটা সমস্যা হল যথেষ্ট ব্যবস্থা স্বেচ্ছায় কোভিড পরীক্ষা এড়িয়ে গিয়েছেন বহু মানুষ। ফলে চিহ্নিত হননি এমন উপসর্গহীন সংক্রমিতরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাজার হাটে, পাল্লা দিয়ে পুজোর কেনাকেটা চলছে। ফলে উপসর্গহীন সংক্রমিতরা পুজোর সময়ও একই ভাবে ঠাকুর দেখতে বেরোলে সংক্রমণ আটকানো সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন চিকিৎসকদের অনেকে।
চিকিৎসকদের একাংশ মনে করছেন, শুধু ঠাকুর দেখা নয়, পুজো দেওয়া বা পু্ষ্পাঞ্জলি দেওয়ার জন্য জমায়েত হতে পারে। পাড়ায় পাড়ায় আড্ডা জমবে। ভিড় জমবে খাবার দোকানেও। তখন কে কত বিধি মানছেন মাস্ক পরে আছেন, বা দু’গজ দূরত্ব মেনে চলছেন সেটা দেখবে কে? সংক্রমিত কেউ হাঁচলে বা কাশলে আশপাশে থাকা সহজেই সংক্রমিত হতে পারেন। সচেতন না হলে আইন করে যা রোখা যাবে না।
এ ক্ষেত্রে বাসিন্দাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছেন চিকিৎসক ও প্রশাসনের আধিকারিকেরা। তাঁরা বলছেন, রাস্তায় বেরোনো মানুষদের বুঝতে হবে সরকারি বিধিনিষেধ করা হয়েছে তাঁদের ভালর জন্যই। আর কেবল সরকারি নিয়ম করে সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব নয়। বাসিন্দাদের নিজেদের উপলব্দি সবার আগে প্রয়োজন। তাঁদের বুঝতে হবে কেবল এই পুজোতে অন্যবারের মতো আনন্দ না করলে তেমন কিছু ক্ষতি হবে না। কিন্তু এই পুজোয় আনন্দ করার হিড়িকে অন্য অনেকের, পরিবারের সদস্যের এমনকি নিজেদের ভবিষ্যতের পুজোও সঙ্কটের মুখে পড়ে যেতে পারে। সেই উপলব্ধি থেকেই সাবধান হলে সংক্রমণ ঠেকানো সহজ হবে।
তাই চিকিৎসক, প্রশাসনের কর্তাদের অনুরোধ এ বছর পুজোয় বাইরে না বেরিয়ে বাড়িতে থেকেই পুজো উপভোগ করুন সকলে। সংক্রমণ রুখতে টিভিতে পুজো দেখেই পুজো কাটানো বুদ্ধিমানের কাজ। একান্তই বেরোলে এই হোয়াটঅ্যাপের যুগেও ভরসা থাকুক ‘এসএমএস’-এ। অর্থাৎ স্যানিটাইজ়ার, মাস্ক, সোশ্যাল ডিসট্যান্সিংয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy