Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

স্বখাতসলিল

পশ্চিমবঙ্গ এমনই এক রাজ্য যেখানে এই প্রাথমিক কাণ্ডজ্ঞানের কথাটি ধারাবাহিক ভাবে লঙ্ঘিত হইয়া আসিতেছে।

শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৯ ০০:৫০
Share: Save:

সচরাচর যাঁহারা নীরব থাকেন তাঁহারা যখন মুখ খোলেন, তখন বুঝিতে হয় সমস্যা বড় আকার ধারণ করিয়াছে। শিল্পবাণিজ্যের পরিচালকরা সাধারণত রাজনীতির প্রশ্নে বাঙ্‌ময় নহেন। নীরবতা ভাঙিলেও কিছু অতিসতর্ক সুভাষিতেই সীমিত থাকেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁহাদের একাংশের মন্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তাঁহারা বলিয়াছেন, রাজ্য ও কেন্দ্রের সম্পর্ক যেখানে পৌঁছাইতেছে, তাহা শিল্প তথা অর্থনীতির পক্ষে শুভ নহে, রাজনীতির রেষারেষি হইতে অর্থনীতিকে মুক্ত রাখিয়া শিল্পায়নের পরিবেশ রচনা পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যতের স্বার্থে অত্যাবশ্যক। অনুমান করা যায়, যাঁহারা মুখ ফুটিয়া কিছু বলেন নাই তাঁহারাও অনেকেই বক্তাদের সহিত সহমত। এই অনুমানের প্রধান কারণ, মন্তব্যগুলি সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত। এবং মূল্যবান। বস্তুত, যে বিষয়টি এই মন্তব্যে উঠিয়া আসিয়াছে, রাজ্য ও রাজ্যবাসীর পক্ষে অন্য কোনও বিষয়ই তাহার অধিক মূল্যবান নহে। সমস্যাটি, আক্ষরিক অর্থেই, জীবনমরণের। অর্থনীতি মরিলে জীবনের অন্য পরিসরগুলিও বাঁচে না।

অথচ, পশ্চিমবঙ্গ এমনই এক রাজ্য যেখানে এই প্রাথমিক কাণ্ডজ্ঞানের কথাটি ধারাবাহিক ভাবে লঙ্ঘিত হইয়া আসিতেছে। শিল্পবাণিজ্যের স্বার্থ রাজনীতির পায়ে বলি দেওয়াই বঙ্গভূমির ঐতিহ্য, সেই আত্মঘাত সমানে চলিতেছে। ষাটের দশকে বামপন্থী রাজনীতির ধ্বজাধারীদের দায়িত্বজ্ঞানহীন বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের পর অর্ধ শতাব্দী কাটিয়াছে, ধনলক্ষ্মী বঙ্গবাসীর দিকে ফিরিয়া তাকান নাই। তাকাইবার কারণও ছিল না। ষাট-সত্তরের হিংস্র রাজনীতির পরে বামফ্রন্ট জমানায় স্থিতি ফিরিয়াছিল, কিন্তু তাহা অচলাবস্থার স্থিতি। কমরেড জ্যোতি বসু অচলায়তনের বাড়িওয়ালা হিসাবে অতি সফল। তাঁহার উত্তরসূরি এক দশকের মুখ্যমন্ত্রিত্বের মধ্যপর্বে শিল্পায়নের অনুকূল পরিবেশ রচনায় কেবল আগ্রহী হন নাই, তৎপরও হইয়াছিলেন। কিন্তু, দুর্ভাগ্য পশ্চিমবঙ্গের, তৎপরতা এবং হঠকারিতার তফাত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও তাঁহার সহকর্মী এবং পরামর্শদাতারা বুঝিতে পারেন নাই। পার্টি সর্বশক্তিমান, কারণ তাহা সর্বজ্ঞ, সুতরাং নেতারা কাহারও কথা শুনিতে শেখেন নাই। ফলে— আক্ষরিক অর্থেই— বিনিয়োগ আসিয়াও ফিরিয়া যায়।

এবং হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলিবার সেই অপকীর্তির কুবাতাসে বিরোধী রাজনীতির তরী ভাসাইয়া তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। শিল্পবাণিজ্যে ক্রমাগত পিছু-হটিতে-থাকা একটি রাজ্যে কার্যত শিল্পায়নের বিরোধিতা করিয়া একটি দল বিপুল ভোটে জয়ী হইয়া সরকার গড়িতে পারে, এই বিসদৃশ ঘটনাই জানাইয়া দেয়, পশ্চিমবঙ্গ আত্মঘাতীই থাকিয়া গিয়াছে। এবং তাহার যোগ্য শাসক পাইয়াছে। শিল্পায়ন বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন লইয়া সমাজের মাথাব্যথা নাই, শাসকরাও তথা এব চ। বছর বছর বিশ্ব শিল্প সম্মেলনের নামে তামাশা চলে, উৎসব শেষে হাতে পড়িয়া থাকে বিশ্ব বাংলার ঢাউস একখানি ব। সরকার সাড়ম্বরে শিল্প-সহায়ক কমিটি গড়ে, প্রথমে দুই-চারি বার বৈঠক হয়, তাহার পর অতলান্ত বিস্মৃতি। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী শিল্পপতিদের বিশ্বসভায় রাজ্যের গুণগান গাহিয়া ফিরিতে অনুরোধ করিলেন। কী গাহিবেন তাঁহারা, কী শুনাইবেন? শাসকের অপরিমেয় কাণ্ডজ্ঞানহীনতার কথা? দলীয় রাজনীতি দেশের সর্বত্রই আছে। কিন্তু দলীয় স্বার্থে শাসক দল আপন রাজ্যের শিল্পবাণিজ্যের স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটাইতেছে এবং বিরোধীরাও সে জন্য কিছুমাত্র উদ্বিগ্ন না হইয়া নেতির রাজনীতিতেই মগ্ন থাকিতেছে— এমন উদ্ভট কুনাট্য ভূভারতে দুইটি খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন। সর্বাপেক্ষা ভয়ের কথা ইহাই যে, পশ্চিমবঙ্গের সমাজ দৃশ্যত এই নেতিকেই আপন নিয়তি বলিয়া মানিয়া লইয়াছে। সে সার বুঝিয়াছে যে, রাবণে মারিলেও মরিতে হইবে, রামে মারিলেও।

অন্য বিষয়গুলি:

Politics West Bengal Industry
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy