Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই হাল বানিয়ে এখন সব দোষ ডাক্তারদের

শাসকরা দায় নেবেন না?

কর্তৃপক্ষের ওপর রাগে সাধারণ মানুষের প্রতি নির্দয় হওয়ার মতো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াটা সংযত করতে না পারলে সমাজে ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাসকে রোধ করা যাবে না।

বিক্ষোভে শামিল ডাক্তারি পড়ুয়ারা।

বিক্ষোভে শামিল ডাক্তারি পড়ুয়ারা।

কুমার রাণা
শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৯ ০০:৩৬
Share: Save:

এর চেয়ে বড় বিড়ম্বনা আর কী আছে? ডাক্তারি ডিগ্রি পেতে গেলে একটা শপথ নিতে হয়: নারী বা পুরুষ, স্বাধীন নাগরিক বা দাস, কারও কোনও ক্ষতি না করার, কারও সঙ্গে ন্যায়বিরুদ্ধ আচরণ না করার প্রতিজ্ঞা। অথচ, সেই ডাক্তারদের সঙ্গেই অবিরাম ঘটে চলা নানা অন্যায়কে মান্যতা দিতে গিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তের সরকার বা কর্তৃপক্ষ শরণ নেয় ডাক্তারদের গৃহীত শপথবাক্যের। তাঁদের বলা হয়, মুখ বুজে কাজ করে যাও, যা-ই ঘটুক না কেন, তোমরা এমন এক মহান পেশা বেছে নিয়েছ যেখানে আত্মস্বার্থ বলে কিছু থাকতে নেই, রোগীর স্বার্থই তোমার স্বার্থ। না, এমনকি ডাক্তারের প্রাণহানির আশঙ্কাও তার চেয়ে বড় নয়।

এই সে-দিন, ২০১৮’তে মহারাষ্ট্রে ডাক্তাররা সরকারের কাছে রোগীর আত্মীয় বা অন্যান্যদের হাতে প্রহার-নিগ্রহের আশঙ্কা থেকে নিরাপত্তা চেয়ে অনুরোধ-উপরোধ জানালেন। ফল হল না। তাঁরা ধর্মঘটে গেলেন। সরকার তাঁদের হুমকি দেওয়ার সময় মনে করিয়ে দিল, ‘ডাক্তারি পেশাটা আর পাঁচটা পেশার মতো নয়।’ একই কথা শোনা গিয়েছে ২০১৭’য় রাজস্থানে, ২০১০-এ দিল্লিতে। আবার স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে বিশ্বে দৃষ্টান্ত-সৃষ্টিকারী ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেরেমি হান্ট-এর গলায়ও একই কথা, ২০১৬’য় জুনিয়র ডাক্তারদের ন্যায়সঙ্গত দাবিদাওয়া নিয়ে ধর্মঘটের প্রসঙ্গে।

হিপোক্রেটসের শপথ কণ্ঠস্থ রেখেও, এবং কর্তৃপক্ষের সদুপদেশে মোড়া হুমকি অস্বীকার করেও বিশ্বের নানা প্রান্তে ডাক্তারদের যে ধর্মঘটে যেতে হয়, তার প্রধান কারণ সংশ্লিষ্ট দেশের শাসকদের লোক-বিরোধী উদ্যম ও সেই সঙ্গে লোক-দেখানো ভণ্ডামি। স্বাস্থ্য খাতে খরচ কমিয়ে দেওয়া, পরিকাঠামোগত উন্নতিতে অবিমিশ্র অবহেলা, ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবন ও জীবিকা বিষয়ে চোখ-কান বন্ধ রাখার মতো দুর্বৃত্তিই পৃথিবীর অনেক দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। সঙ্কটকালে সব দোষ ডাক্তারদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে শাসক নিরাপদ বলয়ে ঢুকে পড়ে।

পশ্চিমবঙ্গ এই ধোঁয়াটে স্বাস্থ্যবিশ্বের বাইরে নয়। কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালে রোগী-মৃত্যুর পরে ডাক্তারদের ওপর প্রাণ-সংশয়ী আক্রমণের প্রতিবাদে তাঁদের ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে সরকার এখনও পর্যন্ত বাণী দিয়েই খালাস: রোগীদের প্রাণের কথা ভাবুন। কিন্তু, ডাক্তারদের প্রাণটা কি ঘুঁটে না কাঠকয়লা? ‘সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ’ প্রার্থনা কি তাঁদের জন্যও নয়? তাঁরা কি যুদ্ধক্ষেত্রে আছেন যে, তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়া যায় না? সরকার জানে না হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ কতখানি, এবং ডাক্তারদের সেই চাপ সামলাতে নাভিশ্বাস ওঠে? ডাক্তার অপ্রতুল, সবাই জানে। কিন্তু এই অবস্থাতেও স্বাস্থ্যব্যবস্থার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য দেশের ও বিশ্বের স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বহু দিন ধরে যে-সব নিদান দিয়ে আসছেন, সেগুলো ফলবান বলে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও দেশ ও রাজ্যের সরকার গ্রহণ করেনি। সে-নিদানগুলোর মধ্যে সবার আগে আছে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যাকে এমন ভাবে উন্নীত করা, যাতে হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ কমে। সরকার সে-পথে হাঁটেনি, উল্টে মানুষের স্বাস্থ্যকে একান্ত হাসপাতাল-নির্ভর করে তুলতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কবিগান চলছে আয়ুষ্মান ভারত ও স্বাস্থ্যসাথীর মতো প্রকল্পের উৎকর্ষ নিয়ে, যে দুটোই প্রাথমিক স্বাস্থ্যের দায় ঝেড়ে ফেলে হাসপাতাল-কেন্দ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর।

অসহায় মানুষের বেড়ে চলা দুর্ভোগ হল স্বাস্থ্যকে তার সামগ্রিক রূপে না দেখার এবং সে দায় স্বীকার না করার পরিণতি। কিন্তু এই সাধারণ সমস্যাটা ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক-আর্থনীতিক পরিবেশে আলাদা আলাদা ভাবে দেখা দেয়। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অ-নিরাপত্তা, তাঁদের ওপর আক্রমণ, এবং তার প্রতিবাদে ডাক্তার ধর্মঘট নতুন ব্যাপার নয়, কিন্তু এ-রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সমস্যাটাকে বিশেষ ঘোরালো করে তুলেছে। হাসপাতাল বিষয়ে ওয়াকিবহাল মাত্রেই জানেন, রোগীর পরিজন বলে যাদের কথা বলা হচ্ছে, প্রায়শই তারা পাতানো আত্মীয়, রোগীর দুঃখকষ্ট যাদের আখের গোছানোর পুঁজি। হাসপাতালগুলোকে কেন্দ্র করে নীতি ও আইন ভাঙার যে বিস্তৃত কারবার, তা কি সরকারের অজানা? প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো ওয়াকিবহাল নয় এ বিষয়ে? তথাপি, সরকার, বিরোধী পক্ষ, তথাকথিত নিষ্পক্ষ নাগরিক সমাজ, সবাই নিষ্ক্রিয়তার অনুশীলনে মগ্ন থাকে।

ফলের ভারে ঝুঁকে পড়েছে বিষবৃক্ষের ডাল। সে বিষে ডাক্তারের নিরাপত্তা ও রোগীর নিরাময় তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেই, তার সঙ্গে বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে রোগী ও ডাক্তারের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক। রোগীকে ডাক্তারের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে হয়। যে হেতু তিনিই রোগ বিষয়ে সম্যক জানেন, এবং তিনি রোগীর ক্ষতি না করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তাঁকে সারাক্ষণ নিজের কাছেই দায়বদ্ধ থাকতে হয়, যাতে হাত ফস্কেও চিকিৎসায় সামান্য ত্রুটি না ঘটে। এমন নয় যে, সবাই সেই আদর্শ সম্পূর্ণ মেনে চলেন। কিন্তু, হাসপাতালে হাসপাতালে কোটি কোটি মানুষের নিরাময় হয়ে ফেরা ও না-ফেরার পার্থক্য এত বেশি যে, কতিপয় বিচ্যুতির জন্য সমগ্র ডাক্তার সমাজের ওপর থেকে আস্থা উঠে যাওয়ার বিন্দুমাত্র যুক্তি নেই।

তা হলে কেন এই অনাস্থা? আগেই বলেছি, এর দুটো বড় কারণ: হাসপাতালের ওপর অকল্পনীয় চাপ, এবং তা থেকে সৃষ্ট পরিবেশ, যা সাধারণ মানুষের মনে খুব ভাল ছাপ ফেলে না। দুই, এই অব্যবস্থার ফাঁক গলে রাজ্যের সাধারণ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তি ও অসহিষ্ণুতার পরিবেশের ঢুকে পড়া। কাণ্ডজ্ঞান থেকেই জানা যায়, রোগী ও তাঁর পরিজন হাসপাতালে ডাক্তার পেটাতে আসেন না। আসে অন্য কেউ। এখনও সময় আছে, এই ‘অন্য কেউ’দের নিয়ন্ত্রিত করার। ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চাই ঠিকই, কিন্তু তার জন্য বসে না থেকে এখনই এখনই কিছু যথার্থ সাহসী পরিবর্তন আনা যায়, ডাক্তারদের নিরাপত্তাদানের বিষয়টা যার মধ্যে প্রধান। রোগীকে চিকিৎসা পাওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ সাহায্যের ব্যবস্থা করাও অতি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। রোগীর পরিজনদের শুধু নির্দিষ্ট ডিপার্টমেন্টে যেতে যে হয়রানিটা হতে হয়, সামান্য চেষ্টায় সরকার সেটা দূর করতে পারে। তা করতে হলে অনাহূত দুষ্কৃতীদের অবিলম্বে হাসপাতাল থেকে দূর করতে হবে। সরকার সে সাহস দেখাবে? এই সঙ্গে পাহাড়প্রমাণ ভুলগুলো শোধরাতে হবে, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার দাবিকে বিন্দুমাত্র অবহেলা করা চলবে না। উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা এবং চিকিৎসকের আদর্শগত দৃঢ়তার মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। ক’বছর আগে আফ্রিকায় হন্তারক ইবোলা রোগে আক্রান্ত মানুষদের সেবায় সব থেকে আগে ও সব থেকে বেশি সংখ্যায় ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা রওনা দিয়েছিলেন যে দরিদ্র দেশটা থেকে, তার নাম কিউবা। এটা কাকতালীয় নয়— কিউবা সরকার স্বাস্থ্যসুরক্ষাকে গ্রহণ করেছে নৈতিক দায়বদ্ধতা হিসেবে। পীড়িতকে দেশকালের সীমানায় বাঁধা যায় না। তার সেবা বিশ্ব-মানবিক কর্তব্য।

মানবতার কর্তব্যের কথা মনে রেখে ডাক্তারদের প্রতিও একটা সবিনয় অনুরোধ রাখা যায়। শপথবাক্য স্মরণ করিয়ে দেওয়াটা ঔদ্ধত্য, কিন্তু রোগী-ডাক্তার সম্পর্কটাকে বিনষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে তাঁরা যদি ধর্মঘট করে চিকিৎসা বন্ধ রাখার বদলে আন্দোলনের অন্য পন্থাগুলোর কথা ভাবেন, তা হয়তো রোগীর প্রাণ বাঁচানোর মতোই বড় অবদান বলে গণ্য হবে। কর্তৃপক্ষের ওপর রাগে সাধারণ মানুষের প্রতি নির্দয় হওয়ার মতো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াটা সংযত করতে না পারলে সমাজে ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাসকে রোধ করা যাবে না। ডাক্তাররা শুশ্রূষা করেন। শুশ্রূষার আদি অর্থ শোনার ইচ্ছা। রাজ্যের মানুষ তাঁদের কিছু বলতে চান, সেটা শোনাও তাঁদের বৃহত্তর কর্মতালিকার অংশ। বস্তুত, দৈনন্দিন আচরণে তাঁরা এই গুণটির অনুশীলন করলে সমাজের অশেষ মঙ্গল ঘটতে পারে। ডাক্তার যদি শুধু একটু সহৃদয় ভাবে রোগীর কথা শোনেন এবং তাঁর সঙ্গে একটু ভাল করে কথা বলেন, তা হলেই অনেক সমস্যা রোধ করা যায়। অনেক ডাক্তারই তেমনটা করেন, জানি, কিন্তু সবাই করেন কি?

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy