স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আলিপুরদুয়ারের প্রান্তিক জনপদ কুমারগ্রাম দুয়ারের গুরুত্ব অবিস্মরণীয়। ব্রিটিশদের খাসমহল ছিল কুমারগ্রাম অঞ্চল। ‘নন রেগুলেশন’ আইন কার্যকরী ছিল সেখানে। কোঙার থেকে কুমারগ্রাম নামের উৎপত্তি। জানা যায়, কুমারগ্রামের জোতদার ছিলেন হংসদেব কোঙার। অসম-ভুটান সীমান্তে অবস্থিত জনজাতি ও উপজাতি প্রধান অঞ্চল কুমারগ্রাম। ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
১৮৯০ সালে ইংরেজরা কুমারগ্রামে থানা নির্মাণ করে। এই প্রান্তিক জনপদই ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল এক সময়। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তা উপেক্ষিতই। কংগ্রেস গঠিত হওয়ার পর থেকেই এই অঞ্চল জুড়ে বিভিন্ন জনজাতির মানুষ সংগঠিত হতে থাকেন। কুমারগ্রামে সেই সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অন্তরীণ করে রাখা হত। স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন রাজবংশী সম্প্রদায়ের মঘা দেওয়ানি। তার আগে এলাকায় ইংরেজেরা চা-বাগান গড়ে তুলেছে। ছোটনাগপুর জেলা থেকে চা-বাগানের জন্য শ্রমিকদের আনা হয়। স্বদেশি আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আলিপুরদুয়ার মহকুমা হাটগুলি ছিল এই অঞ্চলের রাজনৈতিক প্রচার আন্দোলনের কেন্দ্র। চা-বাগিচার শ্রমিকদের ভিড় উপচে পড়ত গ্রামীণ হাটে। মেলার রূপ নিত।
সাইমন কমিশন বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের পর্বে গ্রামীণ হাটগুলিকে কেন্দ্র ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন তীব্র ভাবে দানা বাঁধে। এই সমস্ত হাট থেকেই ইংরেজরা খাজনা আদায় করত। স্বাভাবিক ভাবেই ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ মঘা দেওয়ানি, পোয়াতু বর্মণ, ডুয়ার্স-গাঁধী নলিনী পাকড়াশীরা এই সব গ্রামীণ হাটকেই বেছে নেন ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্র হিসেবে। শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। কুলতুলির হাটটিরও অবস্থান ছিল চা-বাগান অধ্যুষিত এলাকায়। ইংরেজদের খাসমহল থেকে চা-বাগানের রসদ সংগ্রহের কেন্দ্র ছিল কুলতুলির হাট।
তীব্র আন্দোলনের ফলে প্রত্যন্ত অসম সীমান্তে সরে যায় কুলতুলির হাট। লোককবির কবিতা তখন মুখে মুখে— ‘হাটবন্ধ কুলকুলি বন্দে মাতরম হামার বুলি’। লোকগানের কলিতে খাজনা বয়কট আন্দোলন তীব্রতা পেয়েছিল। লোককবির ভাষায়— ‘ভাত দিম, পানি দিম, খাজনা দিম না, জান দিম, পান দিম, খাজনা দিম না’। বয়কট আন্দোলন, খাজনা বর্জন সব মিলিয়ে অন্য মাত্রা পায়। মঘা দেওয়ানি-সহ ৫২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আলিপুরদুয়ার আদালতে নিয়ে এলে স্থানীয় জনজাতির মানুষ ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন।
১৯২৭ সালে শুরু হয় সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন। স্থানীয় বিপ্লবীরা সেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠন করে সরাসরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। অভিনব উপায়ে শামুকতলা হাট বয়কট করা হয়। খোয়া বাঁধানো পথে সারিবদ্ধ গরুর গাড়িতে মাল বোঝাই করে কর্মচারীরা যেতেন হাটবারে। গাড়োয়ানেরা ঘুমিয়ে পড়তেন। প্রথম গরুর গাড়িটিকে অনুসরণ করে পিছনের গাড়িগুলি চলত। হাট চালু রাখার প্রশাসনিক হুমকি থাকায় বাধ্য হয়ে আলিপুরদুয়ারের দোকানিরা রাতেই গরুর গাড়িগুলিকে রওনা করিয়ে দেন। গভীর রাতে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী মাঝপথে দু’একটি গাড়িকে পার করিয়ে দিয়ে বাকি গাড়ির বলদের রশি ধরে আলিপুরদুয়ারের মুখে ঘুরিয়ে দেন। অভিনব উপায়ে হাট বয়কট সফল হয়। পরের দিন দারোগাবাবু-সহ লাল পাগড়িধারী পুলিশ বাহিনী গিয়ে টের পায় যে, অধিকাংশ বিক্রেতাই অনুপস্থিত। ইতিউতি ঘোরাঘুরি করছে কিছু ক্রেতা। ব্রিটিশ খাসমহলে হাট বয়কট করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন অকুতোভয় সংগ্রামীরা। মঘা এবং তাঁর সঙ্গীরা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কুমারগ্রাম এলাকায় মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলার দুঃসাহসিক পরিকল্পনা করেন। মঘা দেওয়ানির বাড়িতে গোপন বৈঠকে হয়। টেলিগ্রাফের মাধ্যমেই সব খবর পাচার হয়ে যেত প্রশাসনের অন্দরে। তাই তার কেটে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে তারকাটা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। বিপ্লবী নলিনী পাকড়াশির ভুমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।
১৯৪২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কুমারগ্রাম থানা দখলের পরিকল্পনা শুরু হয়। দুর্গম বনাঞ্চল, ভয়ঙ্কর রায়ডাক নদী পার হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা কুমারগ্রাম এলাকায় থানা দখলের লক্ষ্যে জড়ো হতে থাকেন দলে দলে। রাতের অন্ধকারে পোস্ট অফিস আর থানার তার কেটে ফেলা হয়। মহকুমার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিরধনুক, বল্লম, বন্দুক ও প্রচুর পরিমাণে কেরোসিন তেল নিয়ে কুমারগ্রাম থানা চত্বরে কাতারে কাতারে মানুষের ঢল নামে। তা সামলানোর মতো শক্তি ছিল না দারোগার। তিনি আন্দোলনকারীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। সহমত পোষণ করে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেন।
তবে, এ সবই ছিল সেই দারোগার কৌশল এবং ছল। তিনি জাতীয় পতাকাও তোলেন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে নিয়ে। এ দিকে মহকুমাশাসকের কাছে একটি চা-বাগানের মাধম্যে খবর পৌঁছে যায় যে, থানা দখল হয়েছে। চা-বাগান তারকাটা না হওয়ায় সহজে সংবাদ আলিপুরদুয়ারে পৌঁছে যায়। খবর পেয়ে চা-বাগান মালিক-কর্মচারীরা জনতাকে হটাতে সশস্ত্র হয়ে
আসছেন দেখে পুলিশ তখন ঘোষণা করে, আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করা হল।
কিন্ত এত সহজে দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না তাঁরা। দৃঢ়চেতা সংগ্রামী পোয়াতু বর্মণ বলেছিলেন— ‘চালা ক্যানে গুলি, দেখি তোর কতখানি গুলি আছে!’ ভীত দারোগা তখন আবারও কৌশলী ঢঙে আন্দোলনকারীদের চাবি দেওয়ার ছল করেন। থানা তাঁদের দখলে আছে জানালে আন্দোলনকারীরা সরে যান। পরে আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করা হয়। ধরা পড়েন বিপিন দাস, ভৈব্যনাথ দাস, স্বর্ণমোহন পণ্ডিত, যোগেন নার্জিনারি, পোয়াতু দাসের মতো নেতাদের। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তি পেয়েছিলেন তাঁরা।
কুমারগ্রামের মতো প্রত্যন্ত এলাকার এই সব ইতিহাস সংরক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। কুমারগ্রাম থানা দখলের মতো আন্দোলন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক গৌরবজ্জল অধ্যায়।
(লেখক নজরুল শতবার্ষিকী বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy