দেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের কর্ণধার যখন বলেন যে ব্যাঙ্ক টাকা লইয়া বসিয়া আছে, কিন্তু ঋণ লওয়ার লোক নাই, তখন সমস্যাটির গভীরতা বোঝা যায়। ব্যাঙ্কের বাণিজ্যিক মডেলটি এই রূপ— ঋণ প্রদান করিয়া ব্যাঙ্ক যে সুদ অর্জন করে, তাহার একটি অংশ যায় আমানতের উপর সুদ দিতে; আর একটি অংশ দিয়া ব্যাঙ্কের নিজস্ব ব্যয়নির্বাহ হয়। ঋণের চাহিদা কমিয়া যাওয়ার অর্থ ব্যাঙ্কের আয়ও হ্রাস পাওয়া। আমানতের উপর সুদ কিন্তু মিটাইতেই হয়। ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানের বক্তব্যে আশঙ্কা হয়, বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির ক্ষেত্রে আয়-ব্যয়ের এই অসঙ্গতি ক্রমে অসেতুসম্ভব হইতেছে। এখনই ইহাকে ব্যাঙ্কিং-সঙ্কট বলিবার কারণ নাই, কিন্তু সঙ্কটের পথ এই মোড় হইয়াই যায়। বিশেষত, কেন্দ্রীয় সরকারের মূল আর্থিক নীতি যদি ব্যাঙ্কঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার হয়, তবে এই পরিস্থিতিতে ব্যাঙ্কিং-সঙ্কটের সম্ভাবনা তীব্রতর হওয়ারই আশঙ্কা। যাঁহারা বিবেচক লগ্নিকারী, এই মুহূর্তে তাঁহাদের ঋণের চাহিদা নাই, কারণ বাজারে পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা তলানিতে ঠেকায় নূতন লগ্নি অর্থহীন। এই অবস্থায় যাঁহারা ঋণ লইয়া লগ্নি করিতে চাহিবেন, তাঁহাদের ঝুঁকি লইবার প্রবণতা বেশি। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ব্যাঙ্ক এই গোত্রের ঋণপ্রার্থীকে এড়াইয়া চলে, অথবা চড়া সুদের হার দাবি করে। এখন ঋণ দেওয়ার তাগিদে এই গোত্রের ঋণপ্রার্থীদেরও ঋণ দেওয়া হইলে তাহার ফল বিষম হইবার সম্ভাবনা প্রকট।
কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিক মন্দা হইতে নিস্তার পাইতে যে পথে হাঁটিয়াছে, তাহার ভ্রান্তি ব্যাঙ্কের বর্তমান সঙ্কটে স্পষ্ট। ইহা অনস্বীকার্য যে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করিতে হইলে নগদের জোগান বজায় রাখিতে হইবে। কিন্তু, সেই কাজটি দ্বিতীয় ধাপের। প্রথম কাজ হইল বাজারে চাহিদার পুনরুদ্ধার। এই মুহূর্তে তাহার একটিই পথ— মানুষের হাতে টাকা দেওয়া। তাহা কর্মসংস্থান যোজনার মাধ্যমে হইতে পারে, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে হইতে পারে, অথবা প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরের মাধ্যমেও হইতে পারে। কিন্তু, মানুষের হাতে টাকা দেওয়া ভিন্ন উপায় নাই। বাজারে এক বার চাহিদা ফিরিলে লগ্নিকারীরাও উৎপাদন বৃদ্ধিতে আগ্রহী হইবেন। তখন অপেক্ষাকৃত সুলভ ঋণের ব্যবস্থা হইলে অর্থনীতির চাকাটি গড়াইতে আরম্ভ করিবে। গত দুই-আড়াই মাস যাবৎ কেন্দ্রীয় সরকার এই কথাটি বুঝিতে সুদৃঢ় ভাবে অস্বীকার করিতেছে। বাস্তব হইতে পলায়নের এই প্রবৃত্তিই দেশকে বর্তমান বিপদের সমীপবর্তী করিয়াছে। সরকার এখন কি নিজের ভুল স্বীকার করিবে? বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা যে পরামর্শ দিতেছেন, নিজেদের অহং ভুলিয়া সরকার তাহা মানিয়া লইবে?
এক্ষণে আরও একটি সঙ্কটের কথা উল্লেখ করা বিধেয়— অনাদায়ী ঋণ। বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের খাতায় অনাদায়ী ঋণের পাহাড় জমিয়াছে। সেই বোঝা সামলাইতে ব্যাঙ্কগুলি নূতন ঋণের উপর সুদের হার যথেষ্ট কমাইতে পারিতেছে না। অর্থাৎ, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক যতখানি সুদ কমাইয়াছে, তাহার সম্পূর্ণ সুবিধা গ্রাহকের নিকট পৌঁছাইতেছে না। এই পরিস্থিতি হইতে উদ্ধারের একটিমাত্র পথ— অনাদায়ী ঋণের সমস্যাটিকে একেবারে সরাসরি আক্রমণ করিতে হইবে। একটি ‘ব্যাড ব্যাঙ্ক’ গঠন করিয়া অনাদায়ী ঋণগুলিকে তাহার খাতায় চালান করিবার প্রস্তাব করিয়াছেন বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির কর্তারা। পথটি অপরিচিত নহে, ফলে তাহার বিপদও জানা। শেষ অবধি অনাদায়ী ঋণের দায় যদি ঋণ প্রদানকারী ব্যাঙ্ককে না লইতে হয়, তবে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ প্রদানের প্রবণতা বাড়িবে বলিয়াই আশঙ্কা। এই পথে হউক বা অন্য কোনও বিকল্প পথে, অনাদায়ী ঋণের সমস্যা সম্পূর্ণ না মিটিলে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে অর্থনীতির পুনরুত্থান কার্যত অসম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy