রিহানা। ছবি: এএফপি।
বিশ্বখ্যাত গায়িকা রিহানা-র সহিত বিখ্যাত গায়ক ক্রিস ব্রাউন-এর প্রেম হইয়াছিল, তাঁহারা একটি বিশ্রী কলহে জড়াইয়া পড়েন ২০০৯ সালে, ক্রিস ব্রাউন সেই কলহের কালে রিহানাকে প্রহার করেন। রিহানার বিক্ষত মুখের ছবি দেখিয়া সেই সময় অনেকেই আঁতকাইয়া উঠিয়াছিলেন। কয়েক দিন পূর্বে একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কে একটি ভিডিয়ো-ক্রীড়ার বিজ্ঞাপন দেখা যাইল, যাহাতে রিহানা ও ক্রিস ব্রাউনের ছবি ব্যবহার করা হইয়াছে এবং লিখা রহিয়াছে, আপনি কী করিতে চাহেন? রিহানাকে চড় মারিবেন, না ক্রিস ব্রাউনকে পিটাইবেন? রিহানা এই বিজ্ঞাপন লইয়া তীব্র তিরস্কার করেন, সোশ্যাল নেটওয়ার্কটি ক্ষমা চাহিয়া বিজ্ঞাপনটিকে স্থানচ্যুত করে। কিন্তু মূল প্রশ্নটি রহিয়া যায়, কী করিয়া কেহ খেলাচ্ছলে ঘরোয়া হিংসাকে লঘু করিতে পারে? আজ যখন #মিটু বা টাইম’স আপ আন্দোলন সমগ্র পৃথিবীকে আলোড়িত করিতেছে, যৌন নিগ্রহ বা যে কোনও নিগ্রহের বিরুদ্ধে নারীরা সর্ব স্তরে প্রতিবাদ গড়িয়া তুলিতে চাহিতেছেন, তাহার প্রেক্ষিতে এই বিজ্ঞাপন যেন অতিরিক্ত অমানবিক ও অনুভূতিহীন বলিয়া প্রতিভাত হইতেছে।
এই বৎসরেই একটি মার্কিন চলচ্চিত্র বিখ্যাত হইয়াছে, ‘থ্রি বিলবোর্ডস আউটসাইড এবিং, মিসৌরি’। এক কিশোরীকে ধর্ষণ করিয়া হত্যা করা হয়। বহু তদন্তের পরও অপরাধী ধরা না পড়ায়, মেয়েটির জননী তিনটি বিলবোর্ড ভাড়া করিয়া বিশাল হরফে লিখিয়া দেন, ‘মারা যাইবার সময়ও ধর্ষিতা’, ‘এখনও কেহ গ্রেফতার হয় নাই?’, ‘কী করিয়া হয়, চিফ উইলোবি?’ ‘বিজ্ঞাপন’গুলি লইয়া অশান্তি হয়, নিগৃহীতা কিশোরীর মা বহু অনুরোধ উপরোধ ভীতিপ্রদর্শন সত্ত্বেও কিছুতেই এইগুলি সরাইতে রাজি হন না। ছবিটি জুড়িয়া মহিলার সংগ্রাম ও তাহার প্রেক্ষিতে সমাজে হিংসার সংক্রমণ এবং সচেতন ভাবে তাহা পরিহারের অনুশীলন সম্পর্কে কিছু কথা বলা হয়। ছবিটিতে মাতার ভূমিকায় অভিনয় করিয়াছেন যিনি, এই বৎসরের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর অস্কার লইবার বক্তৃতায় ‘ইনক্লুশন রাইডার’ আশ্চর্য শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন। ইহার অর্থ, চলচ্চিত্রের অভিনেতা এবং কর্মীদের সমাহারে জাতিগত বৈচিত্র নিশ্চিত করিবার শর্ত। অর্থাৎ কেবল লিঙ্গবৈষম্য নহে, সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি সর্বোচ্চ মঞ্চে জরুরি বার্তা প্রকাশ করিয়াছেন।
কিন্তু এই প্রকারের বহু বার্তা সত্ত্বেও যে সংবেদনশূন্য বহু আচরণ চলিতেছে ও চলিবে, তাহার একটি কারণ পড়িয়া লওয়া যায় এই বৎসরের আর একটি উল্লেখযোগ্য ছবি হইতে, সুইডিশ ভাষার ছবিটির নাম ‘দ্য স্কোয়্যার’। এই ছবিতে, একটি শিল্প-জাদুঘরের আসন্ন প্রদর্শনীর প্রাথমিক বিজ্ঞাপন হিসাবে একটি ভিডিয়ো নির্মিত হয়। বিজ্ঞাপন-নির্মাতারা প্রথমেই মক্কেলদের বলেন, সাম্প্রতিক পৃথিবীতে ইউটিউবের বিজ্ঞাপনে যদি কয়েকটি মাত্র সেকেন্ডের মধ্যে দর্শকে সম্মোহিত বা স্তম্ভিত বা তড়িদাহত না করা যায়, তবে পণ্য বিক্রীত হইবার সম্ভাবনাই নাই। তাই তাঁহারা যে ভিডিয়োটি প্রস্তুত করেন, তাহাতে দেখা যায়, একটি গৃহহীন শিশু কাঁদিতেছে, তাহার পর একটি খেলনা হাতে করিয়া হাঁটিতেছে, তাহার পর একটি বোমার বিস্ফোরণে শিশুটি ছিন্নভিন্ন হইয়া যায়। এই ভিডিয়ো লইয়া প্রবল আলোড়ন ঘটে এবং ছবির নায়ক, যিনি ওই মিউজিয়ামের কিউরেটর, তাঁহাকে পদত্যাগও করিতে হয়। এই ছবিটিও এমন একটি সমাজ লইয়া নির্মিত, যেখানে ঝকঝকে মানুষেরা প্রতিনিয়ত হতদরিদ্র ক্ষুধার্ত ভিখারিদের ডিঙাইয়া নির্বিকার চিত্তে অফিস চলিয়া যান। যেখানে গাড়ির সহিত কাহারও ধাক্কা লাগিলে আহত পথচারীর অপেক্ষা গাড়িটির বিকৃতি লইয়া লোকে অধিক ভাবিত হইয়া পড়ে। সর্বোপরি, সেই সমাজে লোকেরা মানিয়া লয়, মনোযোগ টানিবার খেলায়, নিজ দ্রব্য বিক্রয়ের দায়ে, যে কোনও পদ্ধতিই সিদ্ধ, যে কোনও উপায়ই সঙ্গত, তাহার বিষয় ও ভঙ্গির ঔচিত্য লইয়া গাঢ় ভাবনার প্রয়োজন নাই। প্রবল আলোচিত হইলেই তাহা সার্থক। এই মানসিকতা হইতেই সম্ভবত ‘বিখ্যাত ব্যক্তিকে প্রহার করুন’ ও ওই জাতীয় অন্য ক্রীড়ার উদ্ভব। লোকে মজা পাইবে, অথবা মজা না-পাওয়া লইয়া উত্তেজিত হইবে, উভয় ক্ষেত্রেই ক্রীড়া সংস্থাটি সংবাদের কেন্দ্রে আসিবে, তাহাই অভীষ্ট। বাজারের ব্যাকরণ আসিয়া বুনিয়াদি শিক্ষা রুচি নীতি ন্যায্যতাকে দূরে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছে। তিনটি কেন, তিন শত বিলবোর্ড ভাড়া করিয়াও উহাকে লজ্জিত করা যাইবে কি?
যৎকিঞ্চিৎ
কেউ শহরের দেখভালের দায়িত্বে, কেউ বিখ্যাত ক্রিকেট খেলোয়াড়— খবরে প্রকাশ, তাঁরা বর্ণময় জীবন কাটাচ্ছেন। সাধারণ মানুষের হিংসেয় নীল হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। টিভি দেখতে দেখতে নামজাদা লোকগুলির নিন্দে চলছে, সঙ্গে গোপনে ভাবনা: ইস রে, একেবারে বৈধ পানসে দিনযাপনে দণ্ডিত হয়ে গেলাম! অবশ্য তা কেন, এঁদের প্রেরণায় বেপরোয়া মরিয়া ছকভাঙা হয়ে, গোটা রাজ্য উত্তেজনা ও পুলকে রমরমও করতে পারে, শুধু মোবাইল ঠিকঠাক লুকিয়ে রাখতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy