ভারতে তথাকথিত দক্ষিণপন্থী রাজনীতির একটা লব্জ আছে। সেটা হল ‘বিচারধারা’। অর্থাৎ কোনও একটা বিষয়কে দেখার নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি। ধরা যাক, কাশ্মীর সমস্যাকে আমরা বিভিন্ন ভাবে দেখতে পারি। অতি জাতীয়তাবাদী থেকে বামপন্থী আন্তর্জাতিকতাপন্থী দৃষ্টিকোণ — সব কিছু নিয়েই চর্চা চলতে পারে। এক জনের কাছে কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলেই অন্য জনের কাছে তা হবে না এমন নয়, কিন্তু অন্য মতটি যদি কাশ্মীরবাসীর লাগাতার বিক্ষুব্ধ হওয়ার নেপথ্য কারণগুলির সন্ধানে ব্যাপৃত থাকে, তবে তার সেই স্বাধীনতা থাকা জরুরি। ভারত-পাক সম্পর্কের জঠরে সঞ্চিত হবে সুধারস, না কি বিষবাষ্প—তার জন্য অনন্তকাল অপেক্ষমান দু’দেশের অতি সাধারণ মানুষজন নিয়তই কি প্রত্যক্ষ করবেন সীমান্ত জুড়ে সৈন্যদের আত্মত্যাগ? বিদ্বেষ শতায়ু অতিক্রান্ত হতে পারে, কিন্তু ভিন্ন ‘বিচারধারা’কে সম্মান না জানানো ভারতীয় রীতির মধ্যে পড়ে না। পরেশ রাওয়াল যখন অরুন্ধতী রায় সম্পর্কে আশ্চর্যজনক মন্তব্য করেন, তখন আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে আর গর্ব করা চলে না। বুঝতে হবে, আমরা এতটাই উগ্র আর বিচ্ছিন্ন যে রজ্জুতে সর্পভ্রম হলেও তাকে মানতে চাই না। অরুন্ধতী বন্দুক ধরেননি, পাথরও ছোড়েননি, মত প্রকাশ করেছেন মাত্র, তাতেই এই। আবার পরেশও মতামত জানিয়েছেন, হাতে-নাতে কিছু করতে চাননি, এইটুকুই যা বাঁচোয়া।
ভিন্ন ‘বিচারধারা’র প্রতি সম্মান আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের পরতে পরতে ছিল। ধরা যাক ১৯২২-২৩-এর স্বরাজ্য দলের কথা। ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯২২ সালের চৌরিচৌরার ঘটনার পর গাঁধীজি অহিংস অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন। সৃষ্টিশীল যুব নেতৃত্বের একটি বড় অংশ এই প্রত্যাহার মেনে নিতে পারেননি। দেশবন্ধুর নেতৃত্বাধীন একটি বিক্ষুব্ধ অংশ তৈরি হচ্ছিল। এঁরা কংগ্রেসের মধ্যেই একে অপরের বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকলেন। নানা বিষয়ে মতের অমিল থাকলেও দেশবন্ধু আর গাঁধীজি পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। আবার গাঁধীজির সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ মত থাকলেও অপর মতকে লালনপালন করার গুরুদায়িত্বও তিনি নিয়েছিলেন। কংগ্রেসের অফিশিয়াল লাইন ছিল অসহযোগ। দেশবন্ধু, মতিলাল নেহরুরা তর্ক তুললেন যে, আন্দোলন যখন থেমেই গেছে তখন আইনসভায় অংশগ্রহণ করে ব্রিটিশ সরকারকে নাস্তানাবুদ করা যাক। গাঁধীজি মানলেন না। তৈরি হল কংগ্রেস-খিলাফত-স্বরাজ্য দল। সি আর দাশ সভাপতি আর মতিলাল নেহরু সম্পাদক। সুভাষচন্দ্র অন্যতম কার্যকর্তা। ১৯০৭-এর সুরাটের মতো কংগ্রেস ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু হল না, গাঁধীজি নিদান দিলেন যে, যত খুশি বিতর্ক বা টিপ্পনি কাটা হোক, দল ভাঙা যাবে না। স্বরাজ্য পন্থীরা ভোটে দাঁড়ালেন। অনেকে জিতলেন। কিন্তু ১৯২৫ সালে দেশবন্ধুর অকালপ্রয়াণ সেই সম্ভাবনা অচিরেই বিনষ্ট করল। অবশ্যই যে কোনও রাজনৈতিক সম্ভাবনা সম্পূর্ণ বিকশিত না হতেই পারে। কিন্তু ইতিহাস পেল তার চর্চার উপাদান, যা পরবর্তী প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করল। স্বরাজ্য দল নিয়ে মতিলালের সঙ্গে জওহরলাল তর্কে নামলেন। পিতা-পুত্রের মতান্তর বড় কথা নয়, এর মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করল পূর্ণ স্বরাজের দাবিদার পরবর্তী রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এটা অনেক বড় কথা।
এই রাজনীতিকে আমরা দক্ষিণপন্থী বলব, কারণ তা উগ্র বিপ্লব পন্থাকে সমর্থন করেনি। যে কোনও উপায়ে ক্ষমতা দখল এবং তাকে আঁকড়ে থাকার প্রবণতাই আমাদের একমাত্র ঐতিহ্য নয়, তা স্বীকার করা যাক। মত ও পথের দ্বন্দ্ব বিভিন্ন দলের মধ্যে যেমন থাকে তেমনই একটি দলের অভ্যন্তরেও থাকতে পারে। জাতীয়তাবাদী মানেই কাশ্মীর সমস্যাকে সর্বদা সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে হবে — তার কোনও মানে নেই।
চিন্তার কারণ হল, আমাদের দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে এক অদ্ভুত শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন ‘বিচারধারা’ অনুযায়ী মতামত পাওয়া যাচ্ছে না। জনজীবনে আলোড়ন ফেলে দেওয়া সমস্যাগুলির সমাধানে কী কী করা যেতে পারে তা নিয়ে নতুন চিন্তা উঠে আসছে না। বিভিন্ন বিচারধারার মধ্যে লড়াইও হচ্ছে না। ফলে পরবর্তী প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার কাজটি কঠিনতর হয়ে উঠছে।
পিতা-পুত্রের লড়াই দেখছি। জমাটি লড়াই। কিন্তু তা নিছকই দলীয় মনসবদারির আকচা-আকচি। তাও মুলায়মের এক জন অখিলেশ আছেন, যিনি নিজের মতো চলতে চান। অন্য দলগুলির অবস্থা খুব একটা আশার আলো দেখাচ্ছে না। আম আদমি পার্টির দ্বন্দ্বও ব্যক্তিকেন্দ্রিক, রাজনৈতিক নয়। বিজেপির নেতা পরিবর্তন হয় ঠিকই কিন্তু বক্তব্য পরিবর্তিত হয় না। ক্রমশই অধিকতর উগ্র এবং একমাত্রিক আকার নেয়। অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যেও নেতৃত্বকে যথেষ্ট রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে টেনে আনার মতো যুগোপযোগী যুব নেতারা কোথায়? দলের প্রতিষ্ঠিত মত, পথ বা কৌশলকে প্রশ্ন না করলে নতুন রাজনীতি জন্মলাভ করবে কী ভাবে? সব দলেই যুব নেতারা আছেন কিন্তু তাঁরা নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারেন না। ফলে জনমানসে দলের একটা স্থায়ী এবং প্রচলিত ধারণাই গেঁথে যায়। এই প্রচলিত ধারণা তৈরি হওয়ার রাজনীতি প্রকৃতপক্ষে চিহ্নিতকরণের কাজ করে যা কতকগুলি স্থির কাঠামো নির্মাণ করলেও সামাজিক সচলতার পক্ষে হানিকর।
বামপন্থী রাজনীতির কাছে যা চাওয়ার ছিল, তা আজ সামাজিক পরিসরে অরুন্ধতী রায়ের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে চাইতে হবে। দলীয় স্তরে তা পাওয়ার আশা প্রায় নেই। কিন্তু এ দেশে দক্ষিণপন্থার একটি অনবদ্য ঐতিহ্য আছে। তাকে পরেশ রাওয়ালের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না।
বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy