বাতে সাহিত্যে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত । সেই বিরল কথাশিল্পীদের একজন যাঁদের লেখার ছত্রে ছত্রে জড়িয়ে আছে দেশের মাটি ও মানুষের কথা । শরৎচন্দ্র এবং তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে দেশীয় ঐতিহ্যের আভাস থাকলেও পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্য সম্পূর্ণভাবেই হয়ে উঠেছে নাগরিক। গ্রাম সম্পর্কে বর্তমানকালের লেখকদের তীব্র অনীহায় সাহিত্যের পাতায় নাগরিক বৃত্তের বাইরে থাকা বিরাট এক অংশের আঁচ পাওয়া একসময় প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হয়েছিল।এক্ষেত্রে লেখক সিরাজ বাস্তবিকই ব্যতিক্রম,গতানুগতিকতার স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে না দিয়ে তিনি তাঁর উপন্যাসে বলে গিয়েছেন মাটির কথা,দেশের কথা বিশেষত স্বাধীনতা-উত্তরকালে বদলে যাওয়া গ্রামবাংলার কথা । গ্রামের মানুষ, তার সমাজ, চরিত্রের বদল সমস্ত কিছুকে লেখক সজাগ পর্যবেক্ষকের মতই উপন্যাসের পাতায় বিবৃত করেছেন। শহুরে পাঠকের চোখের পাতা থেকে অজ্ঞতার পর্দা সরিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, শহরে যখন পালাবদলের হিড়িক চলছিল গ্রাম তখন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিল না। সামাজিক, অর্থনৈতিক পালাবদলের দৌড়ে সেও সামিল হয়েছিল।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের শৈশব কৈশোরের বেড়ে ওঠাটাই এক অলীক জগতের আখ্যান। সাহিত্যিকদের অনেকেই মধ্যেই বোহেমিয়ান হওয়ার একটা প্রবণতা থাকে।কিন্ত সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ সেই লেখক যাঁর জীবনের প্রায় সিংহভাগ গড়ে উঠেছিল বোহেমিয়ান জীবনের দর্শনকে ভিত্তি করে। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জন্ম ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে১৪ই অক্টোবর মুর্শিদাবাদ জেলার খোশবাসপুর গ্রামে । পিতা সৈয়দ আবদুর রহমান ফেরদৌসী এবং মা ছিলেন আনোয়ারা বেগম । একই সঙ্গে শৈশব-কৈশোরে দুই বিপরীতধর্মী জীবনকে উপভোগ করেছেন তিনি। একদিকে পারিবারিক শিক্ষা অন্যদিকে উন্মুক্ত পৃথিবীর কোলে বেড়ে ওঠা লেখক সিরাজ বাস্তিবিকই হয়ে উঠেছিলেন প্রকৃতিচর। তাঁর গ্রামের কাছেই ছিল দ্বারকা নদীর অববাহিকা অঞ্চল,কাশকুশ ব্যানার জঙ্গল। আবাল্য বেড়ে ওঠা খোশবাসপুরের তৃণভূমি অঞ্চল, রাখালিয়া জীবন তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল প্রবলভাবে।
এলাকার অনেক মানুষই এই তৃণভূমিকে কেন্দ্র করে বেঁচেছিল। এ তৃণভূমি রাখালদের স্বর্গরাজ্য ছিল। লেখক স্কুল পালিয়ে চলে যেতেন এই রাখালদের দলে। তার চারপাশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বহু দুর্ধর্ষ সব মানুষ ছিল । ছেলেবেলা থেকেই লেখক বহু রক্তপাত, হত্যা দেখেছেন। তিনি এই দুর্ধর্ষ জীবনকে ভালোবাসতেন, তাকে পেতে চাইতেন এবং তা পেতে গিয়েই তিনি প্রকৃতির কাছাকাছি
গিয়ে পড়েন।
তাঁর কথায় –“সে এক আদিম পৃথিবী আছে, দুর্গম রহস্যময়—যেখানে রক্ত ও অশ্রুর কোনো পৃথক মূল্য নেই। সেখানেই আছে খাঁটি স্বাধীনতা ।” এ অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে অমূল্য যা কোনও শহরবাসী লেখকের কব্জা করা সম্ভব নয়।তবে শুধু এটুকুই নয়, যৌবনে লেখক সিরাজ মুর্শিদাবাদ,বীরভূম,বর্ধমান,মালদহ,দুমকা অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনজীবনকে প্রত্যক্ষ করেছেন লোকনাট্য দল আলকাপের ‘সিরাজমাস্টার’ হয়ে। এই লোকসংস্কৃতির গভীর অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্যে দিয়ে সিরাজ দেখেছেন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এই সমাজের মানুষকে, দেশের মানুষকে। ধর্মীয় পরিচয় এখানে গৌণ। মানুষ তাঁর কাছে প্রকৃতির সন্তান,ইতিহাসের অংশীদার। প্রকৃতির সঙ্গে ছেলেবেলা থেকেই সিরজের অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল,সেই সময় থেকেই তিনি কবিতাও লিখতেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে ‘অনন্তপুরের গুপ্তকথা’র অনুসরণে তিনি লেখেন ‘খোশবাসপুরের গুপ্তকথা’। এই সময় থেকেই তিনি কবিতাও লিখতেন। পরবর্তীকালে কবি হওয়ার বাসনা এবং আইপিটি আই-এর কাজ তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসে । যদিও কবি হওয়ার বাসনা তাঁর এ যাত্রায় পূর্ণ হয় না। দীর্ঘ ছ’বছর আলকাপের মাস্টার হয়ে কাটাবার পর তিনি ১৯৬৪তে কলকাতার সাহিত্যজগতে ফিরে আসেন উপন্যাসের হাত ধরে। ইতিমধ্যে শ্রীমতী হাসনে আরার সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন তিনি।লেখক সিরাজের জীবনে তাঁর অবদানও উল্লেখ করার মতন। কলকাতায় আসার আগে থেকেই কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর ছোটগল্প প্রকাশিত হতে থাকে । ইবলিস ছদ্মনামে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্প ‘কাঁচি। এরপর পাঠকদের অনুরোধে তিনি স্বনামে লিখতে শুরু করেন। দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘তরঙ্গিনীর চোখ’। ‘কিংবদন্তীর নায়ক’ প্রথম রচিত হলেও,প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘নীলঘরের নটী’।এর পরের সময় ইতিহাস, তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস,ছোটগল্পের সংখ্যা প্রায় আড়াইশো। দীর্ঘ ২৫ বছর আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । সাহিত্যকীর্তির জন্য জীবনে বহু সম্মাননা পান তিনি, তাঁর লেখা’ অলীক মানুষ’ দেশে-বিদেশে পুরস্কৃত হয়েছে।
তাঁর বহু রচনার চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে।কালের নিয়মে এই অসামান্য প্রতিভাধর মানুষটির কলম ৪ঠা সেপ্টেম্বর,২০১২ তে স্তব্ধ হয়ে গেলেও তাঁর লেখনী চিরকাল বাংলা সাহিত্যের প্রবহমানতার সঙ্গে যুক্ত থেকে যাবে। যার প্রধান কারণ তাঁর সাহিত্যের বিষয় ভাবনার অনন্যতা।
সিরাজ তাঁর জন্মভূমিকে হাতের তালুর মতন চিনতেন। তিনি ডুব দিয়েছিলেন এ দেশের লোকায়ত সংস্কৃতির গভীরে। তিনি তাঁর লেখায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন সেই ভারতবর্ষকে,স্বাধীনতা-উত্তরকালে যে ভারতবর্ষ এদেশের সাহিত্যে মুখ দেখাবার জন্য আঁকুপাঁকু করছিল। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলা সাহিত্যের যে ভারতীয়ত্ব অর্জনের প্রয়োজন ছিল মুস্তাফা সিরাজ ছাড়া সমসাময়িককালে সে প্রচেষ্টা অন্য কোনও লেখকের ক্ষেত্রে তেমন ভাবে দেখা যায়নি। সেক্ষেত্রে লেখক সিরাজের প্রচেষ্টা এক অর্থে ছিল সংগ্রামের সামিল। এই সংগ্রামে অবিরত রক্তক্ষরণ হবে জেনেও তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অবিচল থেকেছেন।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর ‘তৃণভূমি’, ‘মায়ামৃদঙ্গ’, ‘জানমারি’, ‘জনপদ জনপথ’ প্রভৃতি উপন্যাস একঅর্থে বদলে যাওয়া গ্রামবাংলার জীবন্ত দলিল।
মুর্শিদাবাদের লোকজীবন, হিজল অঞ্চল তার পটভূমি নিয়ে রচিত উপন্যাস ‘তৃণভূমি’। ১৯৬৭ সালের পশ্চিমবাংলার অস্থির রাজনৈতিক পটভূমি, জোতদার-জমিদারদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলন,নকশাল আন্দোলন,আর্থসামাজিক পরিবর্তনের ঢেউ কীভাবে আদিম তৃণভূমিকে আলোড়িত করেছিল এই উপন্যাস তার সাক্ষী । বদলে যাওয়া গ্রামবাংলার জ্বলন্ত দলিল ‘জানমারি’। অস্তিত্বের সঙ্কট,প্রকৃত শিক্ষার অভাব,কর্মহীনতা প্রতি মুহূর্তে যুবকদের সেখানে বিপথগামী করে । একই অবস্থার আভাস মেলে ‘তখন কুয়াশা ছিল’ উপন্যাসে । ‘সীমান্ত বাঘিনী’ উপন্যাসেও ধরা পড়ে বদলে যাওয়া গ্রামবাংলার রূপ । সেখানে লেখক তুলে ধরেছেন স্বাধীনতা-উত্তরকালে দেশভাগ,অস্তিত্বের টানাপোড়েন, চোরাচালানকারীদের দৌরাত্মে গ্রামবাংলার ক্ষত বিক্ষত অবস্থাকে। ‘মায়ামৃদঙ্গ’এ যেমন লোকনাট্য আলকাপকে ঘিরে ঘনিয়ে আসা সঙ্কটের কথা লেখক সিরাজ বলেছেন,তেমনি ‘নিলয় না জানি’ উপন্যাসে ফুটে উঠেছে নাগরিক সভ্যতার আগ্রাসনে ক্রমাগত বিলুপ্ত হতে থাকা গ্রামীণ আউল-বাউলের নিজস্ব জগৎ । আবার ‘জনপদ জনপথ’ এ দেখি মফঃস্বল হয়ে ওঠা
গ্রামের ছবি । গ্রামবাংলা মানে শুধু নেতিবাচক নয়,ইতিবাচক পরিবর্তনও বটে। ‘রেশমির আত্মচরিত’ ,‘স্বর্ণচাঁপার উপাখ্যান’ যার উদাহরণ। সবশেষে একটা কথা বলতেই হয় যে, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ একটা বিশেষ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে তাঁর সাহিত্য রচনা করলেও তা কখনও সংকীর্ণ পরিসরে আবদ্ধ থাকেনি,তিনি তাকে অনন্তকাল প্রবাহের বিস্তার দিয়েছেন—এখানেই তাঁর কৃতিত্ব।
গবেষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy