অম্বেডকরের চিন্তাভাবনা আজ যে ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে, স্বাধীনতার পরে বোধ হয় সেটা ভাবা যায়নি। স্বাধীনতার মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সমতা এবং ন্যায়ের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত যে ভারতের আশা জাগিয়েছিলেন, তা আজও অপূর্ণ। ভারতের নিম্নবর্গের চোখে অম্বেডকর দ্রুত এক জাতীয়তাবাদী প্রতীকে পরিণত হচ্ছেন, নিম্নবর্গের মানুষ তাঁদের জীবনসংগ্রামে আদর্শগত শক্তি ও প্রেরণার জন্য বাবাসাহেবের শরণ নিচ্ছেন।
জাতপাত এবং অস্পৃশ্যতার কঠোর বিরোধিতায় অম্বেডকরের অবিচল অবস্থানের প্রতি সরকার মৌখিক সমর্থন জানালেও ভারতে দলিতদের উপর আক্রমণের ঘটনা অব্যাহত। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারেই, ২০০৭ থেকে ২০১৭-র মধ্যে দলিতদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের ঘটনার সংখ্যা প্রায় ৬৬ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৭ সালে দলিতদের বিরুদ্ধে অপরাধের বহু ঘটনা আমাদের মনে আছে। এ বছর পয়লা জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের ভীমা কোরেগাঁওয়ের যুদ্ধের দু’শো বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে দলিতদের উপর উচ্চবর্ণের আক্রমণ এবং তার ফলে সংঘর্ষের কাহিনি তো স্মৃতিতে তাজা— সেই ঘটনায় এক জনের প্রাণ গিয়েছিল। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তফসিলি জাতি এবং তফসিলি জনজাতি (অত্যাচার রোধ) আইনের প্রয়োগ শিথিল হওয়ার ফলে দলিতদের ক্ষোভ তীব্রতর হয়েছে। দলিতদের মুক্তির জন্য, সমাজের মূলস্রোতে তাঁদের সসম্মান ভূমিকা অর্পণের জন্য অম্বেডকরের প্রবল আগ্রহ ও সংগ্রাম স্বভাবতই বিশেষ ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
সুযোগবঞ্চিত মানুষের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার প্রতি অম্বেডকরের আগ্রহ তাঁকে মেয়েদের অধিকার ও মুক্তিরও এক প্রবক্তা হয়ে ওঠার প্রেরণা দিয়েছিল। স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি তিনি চেয়েছিলেন, আত্মমর্যাদার দাবিতে মেয়েরা সংগঠিত হোন, সক্রিয় হোন। ১৯২৮ সালের জানুয়ারি মাসে মুম্বইয়ে রমাবাইয়ের তৈরি একটি নারী সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন অম্বেডকরের স্ত্রী। ১৯৩০ সালে নাশিকে তাঁর আয়োজিত কালারাম মন্দির সত্যাগ্রহে প্রায় পাঁচশো মহিলা যোগ দেন। তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হয়ে তবেই মেয়েদের বিয়ে করা উচিত, স্বামীর আজ্ঞাবহ এবং বহু সন্তানের জননী হয়ে জীবন কাটানোটা তাঁদের লক্ষ্য হতে পারে না। বাল্যবিবাহ এবং দেবদাসী প্রথার বিরোধিতায় তিনি ছিলেন মুখর, হিন্দু মেয়েদের সক্ষমতার স্বার্থে হিন্দু কোড বিল প্রণয়নের জন্য জোরদার চেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি।
আধুনিক ভারত বলতে তিনি যা বুঝতেন, সেটা কেবল জাতপাতের বৈষম্য দূর করাতেই সীমিত ছিল না, জাতীয় অর্থনীতি সম্পর্কে তাঁর চিন্তাও এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। জার্নাল অব ইন্ডিয়ান ইকনমিক সোসাইটি-তে ১৯১৮ সালে লেখা একটি প্রবন্ধে তিনি কৃষিজোতের ক্ষুদ্র আয়তনকেই ভারতীয় কৃষির অনগ্রসরতার একটি বড় কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেন এবং বলেন, কৃষিতে বিনিয়োগের পাশাপাশি সমবায় প্রথায় চাষই সীমিত উপকরণে ফলন বাড়ানোর পথ। পাশাপাশি তিনি শিল্প উন্নয়নের উপর জোর দিয়েছিলেন, তাঁর মতে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কৃষির সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্যও শিল্পের উন্নতি বিশেষ প্রয়োজনীয়। তাঁর মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ, সড়ক, পরিবহণ, যোগাযোগ এবং সেচের উন্নতি আবশ্যক, এবং তাতে সরকারের বড় ভূমিকা নেওয়া দরকার। বহুমুখী নদী পরিকল্পনার উপর বিশেষ জোর দেন তিনি। দেশের সুস্থায়ী উন্নয়নের দিশা খুঁজতে তাঁর এই চিন্তাধারা আজও মূল্যবান।
অম্বেডকরের উন্নয়ন-চিন্তায় সামাজিক ন্যায়ের খুব বড় জায়গা ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, শিল্পায়ন হোক একটা ‘সামাজিক ভাবে কাম্য’ স্তরে এবং সমস্ত ভারতবাসী দেশের শিল্পসম্পদের অংশীদার হোক। শ্রমিক কল্যাণের কথাও তিনি গুরুত্ব সহকারে ভেবেছিলেন, ভাইসরয়ের কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে তিনি শ্রমিক-কর্মীদের সামাজিক নিরাপত্তা, ট্রেড ইউনিয়নের স্বীকৃতি এবং শ্রমবিরোধ নিষ্পত্তির আইনি ব্যবস্থার জন্য জোরদার সওয়াল করেছিলেন। আজও শ্রমিক এবং শিল্পমালিকদের মধ্যে গঠনমূলক কথোপকথনের পরিবেশ তৈরিতে তাঁর এই ধারণাগুলি প্রাসঙ্গিক।
অম্বেডকর জানতেন, অর্থনীতিকে খোলা বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে উন্নয়নের সমতা আসবে না। তাই তিনি চেয়েছিলেন একটি গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকার অর্থনীতির উপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। অম্বেডকর-গবেষকরা বলেন, তাঁর চিন্তা ‘রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র’-এর ধারণাটির প্রতি অনুকূল ছিল, স্টেটস অ্যান্ড মাইনরিটিজ গ্রন্থে তা স্পষ্ট। চেয়েছিলেন, কৃষিজমি ও প্রধান শিল্পগুলির মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে থাকুক। জাতীয় উৎপাদন বণ্টিত হোক জাতপাত বা মতাদর্শের বিচার না করে। ভারতীয় রাষ্ট্র এখন জনকল্যাণের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে তৎপর, সেই ভুল পথ থেকে তাকে যথাযথ দিশায় আনার কাজে অম্বেডকরের ভাবনা একটা স্বাস্থ্যকর ভূমিকা নিতে পারে।
অম্বেডকর বুঝেছিলেন, একটা উদার রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য সাক্ষরতার প্রসার চাই, এবং সমাজের বৃহত্তর অংশের মানুষকে নিয়ে আসা চাই উচ্চতর শিক্ষার পরিসরে। তাই তিনি স্লোগান তুলেছিলেন: এডুকেট, অ্যাজিটেট অ্যান্ড অর্গানাইজ— শিক্ষিত করো, আন্দোলন গড়ে তোলো এবং সংগঠিত করো। তাঁর দাবি ছিল, ছাত্রছাত্রীদের এমন ভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা ‘সৃষ্টিশীল মন’-এর অধিকারী হতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘‘শিক্ষার্থীকে এমন ভাবে শিক্ষা দিতে হবে যাতে সে বিচার করতে শেখে, কোনটা তথ্য এবং কোনটা অভিমত। তাকে শিখতে হবে, বিভিন্ন বিষয় কী ভাবে বিশ্লেষণ করতে হয়, প্রত্যেকটি প্রশ্নকে কী ভাবে, কোনও পূর্বনির্ধারিত তত্ত্বের মোহে আবিষ্ট না হয়ে তার নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তি দিয়ে বিচার করতে হয়। যার মত আমি একেবারেই মানি না, তার অবস্থানকেও সুষ্ঠু ভাবে, এমনকী সহানুভূতির সঙ্গে পেশ করতে জানার শিক্ষা অত্যন্ত মূল্যবান। একটা ধারণাকে মেনে নেওয়া বা নাকচ করার আগে সেটি যাচাই করে দেখা, তার পরিণাম বিচার করা, এগুলো সুশিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।’’
মুক্ত চিন্তা ও নির্ভীক বিচারবুদ্ধির বিকাশই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন ও গবেষণার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত, সেটা অম্বেডকর জোর দিয়ে বলেছেন। লক্ষণীয়, তিনি চেয়েছিলেন, স্কুলশিক্ষার পরেই ছেলেমেয়েরা আইন পড়ুক। সাংবাদিকতা বিষয়েও তাঁর স্বচ্ছ চিন্তা ছিল, তিনি মনে করতেন সাংবাদিকরা যেন সামাজিক ন্যায়ের মুখপাত্র হয়ে ওঠেন। মূক নায়ক, বহিষ্কৃত ভারত, সমতা বা জনতা-র মতো পত্রপত্রিকার সঙ্গে তাঁর সংযোগের কাহিনি জানিয়ে দেয়, সৃষ্টিশীল সাংবাদিকতাতেও তাঁর অনেক অবদান ছিল। অম্বেডকরের চিন্তা অনুসরণ করলে আমরা উপলব্ধি করতে পারি, শিক্ষা হল সামাজিক মূলধন, তাই তাকে বেসরকারি পুঁজির হাতে ছেড়ে দেওয়া চলে না।
একটা উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সচল রাখার তিনটি শর্ত চিহ্নিত করেছিলেন অম্বেডকর: হিংসা বর্জন করা এবং জনসাধারণের ক্ষোভবিক্ষোভের মোকাবিলার জন্য সাংবিধানিক পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া; বীরপূজা পরিহার করা; রাজনৈতিক গণতন্ত্রের সঙ্গে সামাজিক-অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের সমন্বয় ঘটানো। তাঁর কাছে গণতন্ত্র নিছক একটি সরকারি কাঠামো নয়, তা কেবল নাগরিক এবং রাষ্ট্রের সম্পর্কও নয়। তিনি মনে করেন, গণতন্ত্র হল ‘সংশ্লিষ্ট জীবনের একটি রূপ’, ‘সমন্বিত সংযোগের এক অনুশীলন’, ‘সহনাগরিকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের এক মানসিকতা’ তার স্বভাবধর্ম। সামগ্রিক কল্যাণের জন্য বিভিন্ন বর্গের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ককে সে বিশেষ মূল্য দেয়। আজ যখন আমরা ভিতরের এবং বাইরের বিভিন্ন সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে ভারতের উদার সাংবিধানিক কাঠামোটিকে রক্ষা করতে চাইছি, তখন অম্বেডকরের এই গণতন্ত্র-ভাবনা আমাদের মূল্যবান পাথেয় হতে পারে।
দুর্ভাগ্যের কথা, অম্বেডকরের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে ছোট করার একটা চেষ্টা চলছে। কিছু বিক্ষিপ্ত উন্মার্গগামী তাঁর মূর্তিকে কলঙ্কিত করতে চাইছে। কিন্তু যাঁরা একটা সত্যিকারের উন্নততর ভারত গড়তে চান তাঁদের কাছে অম্বেডকর যেমন মহান ছিলেন, তেমনই থাকবেন।
ইতিহাসবিদ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। মতামত ব্যক্তিগত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy