Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
rabindranath

সেই সব দিনরাত্রি, এই সব দিন-দুপুর-সন্ধে

ঘটনাগুলি আজও সমান সত্যি, রবীন্দ্রনাথ থেকে তারাশঙ্কর দগ্ধ সময়ের যে ছবি এঁকেছিলেন ধর্মের আড়ালে অকারণ অবিশ্বাসের সে ছবি আজও জলছবির মতো ফুটে ওঠে। লিখছেন সুদীপ জোয়ারদারএমনই অবিশ্বাস সে দিন কলকাতার রাস্তায় হিন্দু সুতামজুরের চোখেও। গল্পের নাম ‘আদাব’।

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২০ ০২:০৬
Share: Save:

গাড়ি ছাড়বার মুখে হঠাৎ স্ত্রীকে নিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক। গাড়িতে রয়েছেন এমন এক জন যিনি ভদ্রলোকটিকে চিনলেন। একই দেশঘর, চিনবেন নাই-ই বা কেন? তবে অবাক হলেন বেশ। দাড়ি হাফিজ কোনও কালেই রাখেন না। কিন্তু গোঁফ? চেনা সহযাত্রীটির মনে হল, ওটা কামানো হয়েছে আজকেই। শুধু কি তাই? হাফিজের স্ত্রীর মাথাতেও নেই বোরখা। সহযাত্রীটির মনে হল হাফিজের স্ত্রীর সিঁথিতে সিঁদুর রয়েছে।

ও দিকে হাফিজ, এতক্ষণ দেখতে পাননি পরিচিত সহযাত্রীটিকে। যেই দেখলেন, তাঁর মুখখানা বিবর্ণ হয়ে গেল। যে হাফিজ দেখা হলেই তর্কে তুফান তুলতেন, পূর্বপুরুষ কান্যকুব্জ থেকে এসেছিলেন বলে পরিচিত সহযাত্রীটিকে এই বাংলায় বিদেশি হিসাবে প্রতিপন্ন করতেন এবং নিজের পূর্বপুরুষকে এখানকার আদি বাসিন্দা হিসাবে ঘোষণা করে নিজেকে ওই পরিচিত সহযাত্রীটির চেয়ে অনেক খাঁটি বাঙালি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতেন, তাঁর চোখে আজ ভয় ও অবিশ্বাস ।

গাড়ির ভিতর হিন্দু যাত্রীরই সংখ্যাধিক্য। পরিচিত মানুষটি তাঁর আসল পরিচয় বলে দেবেন না তো, এমন একটা শঙ্কা হাফিজের চোখমুখ থেকে পরিচিত সহযাত্রীটি পড়ে ফেলেন সহজেই এবং অবাকও হন। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেকার বিশ্বাস কি তা হলে পদ্মপাতায় জল যে হাওয়া দিলেই তৈরি চলকে পড়ার জন্য! আর তখন মুহূর্তেই পালটে যায় চেনা চৌহদ্দি, রূঢ় বাস্তব এসে সজোরে আঘাত করে ‘একই বৃন্তে দুইটি কসুমে’র সুখস্বপ্নে? এ কেমন সম্পর্ক তবে!

১৯৪৬ এর ‘কালো কলকাতা-রক্তাক্ত কলকাতা-নারকীয় কলকাতা’ ছেড়ে কর্মসূত্রে এই শহরে আসা মানুষেরা প্রাণভয়ে ভীত হয়ে যখন দলে দলে ফিরে চলেছেন আপন দেশগাঁয়ের দিকে, সে সময় এমনই এক যাত্রাপথে হাফিজের কাহিনি আমাদের শোনান তারাশঙ্কর তাঁর ‘কলিকাতার দাঙ্গা ও আমি’ গল্পে।

ঠিক এমনই অবিশ্বাস সে দিন কলকাতার রাস্তায় হিন্দু সুতামজুরের চোখেও। গল্পের নাম ‘আদাব’। লেখক সমরেশ বসু। ‘আদাব’ গল্পে দাঙ্গাবিধ্বস্ত রাত্রির কলকাতায় সে দিন দুই প্রান্তিক মানুষ যখন অনেকটাই হয়ে উঠেছিলেন পরস্পরের সহায়, সে সময় বিড়ি ধরাবার জন্য ধার করা দেশলাই জ্বালাতেই চমকে ওঠেন সুতামজুর। বিড়ির আলোয় দেখেন পেশায় মাঝি অন্য প্রান্তিক মানুষটি মুসলমান। তাঁর ঠোঁট থেকে বিড়ি পড়ে যায়। একটা হালকা বাতাস এসে যেন ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয় কাঠিটা।এতক্ষণ ধরে জমে ওঠা সখ্য টাল খায়। অন্ধকারের মধ্যে দু’জোড়া চোখ অবিশ্বাসের উত্তেজনায় বড় বড় হয়ে ওঠে।

মাঝির বগলের পুটুলিটা ঘিরে একটা সন্দেহ এবং ভয় সুতামজুরের মধ্যে পাক খায়। কী আছে ওতে? মাঝি আশ্বস্ত করেন, ‘পোলা-মাইয়ার লইগা দুইটা জামা আর একখান শাড়ি। কাল আমাগো ঈদ পরব জানো?’ মাঝি সুতামজুরের সন্দেহ নিরসনের জন্য পুটুলিটা বাড়িয়েও দেন। সুতামজুর বলে ওঠেন, ‘দেখুম আর কী? তবে দিনকালটা দেখছ ত? বিশ্বাস করণ যায়-তুমিই কও?’

দিনকাল একটু বেসামাল হলে বিশ্বাস যদি এ ভাবে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়ায়, তা হলে যে-বিশ্বাস প্রতিনিয়ত আমাদের কথায়-বার্তায় উছলে ওঠে সেই বিশ্বাসকেও কি বিশ্বাস করা যায়? তখন মনে হয় না কি স্থিতাবস্থার কালটিতে এ অনেকটাই ছিল আমদের দিনযাপনের সুচতুর কৌশল, নিপুণ অভিনয়েরই একটা অংশ!

এই সুপ্ত বা প্রকাশ্য অবিশ্বাসের উৎসকথা এইসব গল্পের বহু আগেই কিন্তু লিখে ফেলেছেন রবীন্দ্রনাথ। আসলে দাঙ্গা রোজ রোজ না হলেও,দুই সম্প্রদায়ের ভিতর সম্পর্কের টানাপোড়েন তো একেবারে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় এদেশে। তাই এই অবিশ্বাস, সন্দেহ যুগচিন্তক রবীন্দ্রনাথকে ভাবিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কলমে উঠে এসেছে সমস্যার আসল কারণ। ‘ভারতবর্ষের এমনি কপাল যে এখানে হিন্দু-মুসলমানের মতো দুই জাত একত্র হয়েছে ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয়, আচারে প্রবল। আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল। এক পক্ষের যে দিকে দ্বার খোলা, অন্য পক্ষের সে দিকে দ্বার রুদ্ধ। এরা কী করে মিলবে?’

এই সমস্যার সমাধানও রবীন্দ্রনাথ দিয়ে গেছেন ‘আমাদের মানস প্রকৃতির মধ্যে যে অবরোধ রয়েছে তাকে ঘোচাতে না পারলে আমরা কোনোরকমের স্বাধীনতাই পাব না। শিক্ষার দ্বারা, সাধনার দ্বারা সেই মূলের পরিবর্তন ঘটাতে হবে ডানার চেয়ে খাঁচা বড়ো এই সংস্কারটাকেই বদলে ফেলতে হবে তার পরে আমাদের কল্যাণ হতে পারবে। হিন্দু-মুসলমানের মিলন যুগ পরিবর্তনের অপেক্ষায় আছে।’ (‘হিন্দুমুসলমান’/রবীন্দ্রনাথ)

১৩৩৮ এর শ্রাবণে এইসব কথা। তার পর সময়ের বিচারে অনেকটাই পথ পেরিয়ে এসেছে দেশ। কত যুগও এসেছে গিয়েছে। কিন্তু ডানার চেয়ে খাঁচা বড় এই সংস্কারটাকে পুরোপুরি ত্যাগ এখনও আমরা করতে পারিনি। উস্কানি, প্ররোচনা এ সব তো সব যুগেই থাকে, থাকবে। কিন্তু দেহ দুর্বল হলে রোগ আক্রমণ রোখা যায় কি? খাঁচার বশ্যতা এখনও রয়েছে বলে আমাদের মধ্যে আজও সম্পর্কের অবনতি হয়। ক্রান্তিকালে হাফিজকে সাজতে হয় হিন্দু। সুতামজুরকে সন্দেহে পেয়ে বসে। মুসলিম রমণীকে খুলতে হয় বোরখা অথবা হিন্দু রমণীকে আত্মরক্ষার জন্য নিতে হয় বোরখার আড়াল।

তবে এই বিরোধের পিঠে মিলনের একটা তিরতিরে ইচ্ছে-নদী বহমান চিরকালই। তাই তারাশঙ্করের বা সমরেশ বসুর গল্প শেষ হয় না সন্দেহে আর অবিশ্বাসেই। তারাশঙ্করের গল্পে হাফিজের হারানো বিশ্বাস, গাড়ি বর্ধমান ছাড়তেই ফিরে আসে। হিন্দু চেনা সহযাত্রীর দিকে ফিরে হাফিজ বলে ওঠেন, ‘এ কি হল দাদা? কেন হল?’ আর ‘আদাব’ গল্পে মুসলমান মাঝিকে বিদায় দেবার মুহূর্তে হিন্দু সুতামজুর বুকভরা উদ্বেগ নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। বুকের ধুকধুকুনি তাঁর বন্ধ হতেই চায় না। মনে মনে তিনি প্রার্থণা করেন-‘ভগবান-মাঝি য্যান বিপদে না পড়ে।’ এই সহমর্মিতাই হয়ত শেষ অব্দি আমাদের বাঁচিয়ে দেয়। পর্যন্ত ভূতিভূষণের ‘ভিড়’ গল্পে এক ভিড় ট্রেনে পুত্রশোকাতুর মুসলিম পিতার উদ্দেশে গাড়ির এক কোণ থেকে এক দাড়িওলা হিন্দু বৃদ্ধ আবেগভরে বলে উঠেছিলেন, ‘ভগবান তোমার মনে শান্তি দিন। আমি বুড়ো বামুন আশীবাদ করছি, ভালো হবে তোমার, ভালো হবে।’ প্রান্তিক মানুষের এই মানবিকতাই আমাদের মূলধন। খাঁচা যতই আমাদের বিরোধ, বিতৃষ্ণা আর অবিশ্বাসের মন্ত্র দিক, মানিয়ে-চলার কৌশল শেখাক, ‘জোড় ভাঙানো দুর্যোগ’ আমরা আজও বারে বারে রুখে দিই এইসব মানবিকতার অস্ত্রেই।

তবে এখানে গৌরব নেই কোনও। হয়ত সান্ত্বনা রয়েছে কিঞ্চিৎ। কিন্তু তাতে অস্বস্তিটা আড়ালে যায় না। আর কালান্তরে এসেও যে আমাদের চেতনার জঞ্জাল পরিষ্কার হয় না, সম্পর্কের মধ্যে চলে বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের টানাপড়েন, এ তো শুধু অস্বস্তির নয়,লজ্জারও!

শিক্ষক,

ভগবানগোলা হাইস্কুল

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy