Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

অপূরণীয়

সেই সম্ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত করিয়াই যেন ওই তরুণী সংবাদমাধ্যমকে বলিয়াছেন, কেবল অর্থ দিয়া ধর্ষিতের জীবন বদল করা সম্ভব নহে। তাঁহার বক্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৯ ০০:২২
Share: Save:

সরকারি ক্ষতিপূরণ প্রত্যাখ্যান করিয়া একটি গুরুতর প্রশ্ন তুলিয়া দিলেন এক ধর্ষিতা। ধর্ষণ যিনি সহিয়াছেন, তাঁহার প্রাপ্য আর্থিক সহায়তাকে কেন ‘ক্ষতিপূরণ’ বলিবে সরকার? অর্থ যাহা পূরণ করিতে পারে, ধর্ষিতার ক্ষতির প্রকৃতি কি সেই রূপ? এই প্রশ্নটি হয়তো নূতন নহে। ইতিপূর্বে পুলিশি নির্যাতন বা প্রশাসনিক অবহেলায় মৃত্যু বা পঙ্গুত্ব ঘটিবার পর অনেক পরিবার ক্ষতিপূরণ লইতে অস্বীকার করিয়াছেন। বলিয়াছেন, আপনজন হারাইবার ক্ষতি কখনওই পূর্ণ করিতে পারে না অর্থ। কিন্তু পশ্চিম মেদিনীপুরের যে অতি-দরিদ্র তরুণী ক্ষতিপূরণ ফিরাইয়াছেন, তিনি অনুদানের অসারতার কথা বলেন নাই। বলিয়াছেন, যত দিন তাঁহার ধর্ষকেরা শাস্তি না পাইবে, তত দিন তিনি সরকারি ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করিবেন না। তাঁহার এই প্রত্যাখ্যানকে বুঝিতে হইলে মনে রাখিতে হইবে, তাঁহার ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত পাঁচ ব্যক্তিই কিছু দিন পূর্বে গুরুগ্রামের আদালত হইতে মুক্তি পাইয়াছে প্রমাণের অভাবে। যাহার অর্থ, বিচার মেলে নাই ওই তরুণীর। যদিও গুরুগ্রামের একটি বেসরকারি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি থাকিবার সময়ে তাঁহার উপর উপর্যুপরি ধর্ষণ হয়, তাহার ডাক্তারি প্রমাণ মিলিয়াছে, এবং আদালতে তাহা পেশও হইয়াছে। ওই তরুণীর সহিত কী ঘটিয়াছে, তাহা পুলিশি তদন্ত এবং আদালতের বিচারই প্রতিষ্ঠা করিতে পারে। কিন্তু প্রমাণের অভাবে ধর্ষণে অভিযুক্তের বেকসুর খালাস পাইবার ঘটনা ভারতে অহরহ ঘটিতেছে। সাম্প্রতিক তথ্যে প্রকাশ, চারটি ধর্ষণের মামলার মাত্র একটিতে অভিযুক্ত শাস্তি পাইয়া থাকে। ধর্ষণের বিচার না পাইবার যে ‘ক্ষতি’, অর্থ দিয়া কি তাহাই পূরণ করিতে চাহে সরকার?

সেই সম্ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত করিয়াই যেন ওই তরুণী সংবাদমাধ্যমকে বলিয়াছেন, কেবল অর্থ দিয়া ধর্ষিতের জীবন বদল করা সম্ভব নহে। তাঁহার বক্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিক্ত সত্য ইহাই যে, ধর্ষণের বিচার ও অপরাধীকে শাস্তি দিবার বিষয়ে রাষ্ট্র বরাবরই পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূ। আজও ভারতে নির্যাতিত মহিলা অথবা তাহার পরিবারের হাতে কিছু টাকা ধরাইয়া দেন পুরুষপ্রধান সমাজের কর্তারা। যেন তাহাই একটি মেয়ের সামাজিক মর্যাদাহানি, দৈহিক পীড়ন এবং মানসিক কষ্টের ‘মূল্য’। এমনকি পুলিশও আদালতে না গিয়া অভিযুক্তের নিকট ‘ক্ষতিপূরণ’ লইয়া ‘ঝামেলা মিটাইতে’ পরামর্শ দেয়। সমাজ ইহাতে অন্যায় দেখিতে পায় না। মহিলাদের ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য পণ্য ভাবিতে সমাজ অভ্যস্ত। যৌনসম্পর্কে মহিলাদের অমত থাকিতে পারে, সে সম্ভাবনাও পুরুষ মানে না। অতএব অপরাধীর অর্থদণ্ডই যথেষ্ট। সরকার যখন যথাযথ তদন্তের দায় এড়াইয়া কিছু টাকা দিয়া ধর্ষিতার প্রতি কর্তব্য সারিতে চায়, তখন রাষ্ট্র কার্যত মোড়ল হইয়া ওঠে। ভুলিয়া যায় যে ধর্ষিতা বিচারপ্রার্থনা করে কেবল অপরাধীর শাস্তির জন্য নহে, অপরাধের স্বীকৃতির জন্য। বিচার না হইলে কার্যত অপরাধকেই অস্বীকার করা হয়।

সংবাদে প্রকাশ, এই প্রথম সরকারি অনুদান এ ভাবে প্রত্যাখ্যাত হইল, তাই সরকারি কর্তারাও বিড়ম্বনায় পড়িয়াছেন। আত্মসমীক্ষা করিলে তাঁহারা বুঝিবেন, সরকারি অর্থ কখনও বিচারের ‘বিকল্প’ হইতে পারে না। নির্যাতনের, অবমাননার প্রতিকার না করিয়া ‘মূল্য ধরিয়া দিয়া’ সরকার নিজ কর্তব্য সারিতে পারে, এই ভ্রান্ত ধারণা চলিতে পারে না। মহিলাদের উপর অপরাধের তদন্ত ও বিচার যথা সময়ে করিবার জন্য বিচারকদের শূন্যপদ পূরণ, বিশেষ আদালত নির্মাণ হইতে পুলিশি ব্যবস্থায় সংস্কার প্রভৃতি সকল সুপারিশ মানিতে হইবে। তৎসহ ভাবিতে হইবে, নির্যাতিতাকে প্রদেয় অর্থকে ‘ক্ষতিপূরণ’ বলিব কেন? ‘আপৎকালীন অনুদান’ অথবা ‘বিশেষ সহায়তা’ বলিলেই হয়তো ঠিক হয়। প্রতিটি ধর্ষণ-নির্যাতন সমাজের যে ক্ষতি করে, তাহা অপূরণীয়।

অন্য বিষয়গুলি:

Compensation Rape Victim
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy