মহিষাসুরকে বধ করার আগে পান করে মত্ত হয়ে গিয়েছিলেন দেবী ।
প্রকৃতি নিজেকে উজাড় করে দেয় আশ্বিনে। ধানগাছগুলোর মাথা নুয়ে পড়ে। খেতের পরে খেত ভরে সেই সোনালি ধানের রং গিয়ে মেশে নীল দিগন্তে। কখনও মনে পড়ে যায়, মার্কণ্ডেয় পুরাণের একটি শ্লোক—‘হিমবান্ বাহনং সিংহং রত্নানি বিবিধানি চ। দদাবশূন্যং সুরয়া পানপাত্রং ধনাধিপঃ।।’ হিমালয় দিলেন দেবীর বাহন সিংহ এবং বিবিধ রত্নসমূহ, আর ধনাধিপ কুবের দেবীকে দিলেন সর্বদা সুরাদ্বারা পরিপূর্ণ একটি পানপাত্র। এই পানপাত্রটিই যেন উপুড় করে ফেলে দেওয়া হয়েছে খেতে। এমন সোনালি রং চারপাশে ঘিরে থাকে, কেমন মাদকতাময় হয়ে ওঠে চারপাশ। কৃত্তিবাসের মনে পড়ে যায়, দেবী ভাগবতেও দেবীর প্রচণ্ড পানের কথা রয়েছে। রণমত্ত সেই দেবী একের পর এক অসুরকে হত্যা করার পরে মহিষাসুরকে বধ করার আগে পান করে মত্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
হাঁটতে হাঁটতে জাহ্নবীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন কৃত্তিবাস। তাঁর উপস্থিতিতে মিশে ব্যক্তিত্বের পরত। গৌড়ের রাজার প্রিয়পাত্র এই কবির প্রখর পাণ্ডিত্যে কিছুটা ম্লান লাগে চারপাশ। তিনিই যেন জ্বলজ্বল করেন সকলের মাঝে। কৃত্তিবাস ভাবতে থাকেন, মহিষাসুরকে বধ করার পরে জাহ্নবীতেই স্নান করতে নেমেছিলেন দেবী, ঠিক তখনই দেবতাদের ডাক পেয়ে সেই অবস্থাতেই তিনি তাঁদের সামনে উপস্থিত হন। কৃত্তিবাসের মনে পড়ল, পদ্মের কেশরের মতো রং গঙ্গার। সেই গঙ্গাই বুঝি দেবীর আরও একটি আভরণ হয়ে রইল। তাঁকে সেই অবস্থাতেই স্তব করেন দেবতারা। ভার দেওয়া হয় শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করার। তাই এই দেবী অনন্যা। কৃত্তিবাস অবাক হয়ে ভাবেন, পুরাণকারের এই দেবী নিজের রূপ ও শৌর্যের ঐশ্বর্যকেও অস্ত্র বলে ব্যবহার করেন?
সেই ভাবতে ভাবতেই শুনতে পেলেন সিংহল থেকে বাণিজ্যতরী এসেছে। গৌড়ে মণিরত্ন এসেছে অনেক। ঝলমল করছে সব। যাঁরা এসেছেন, তাঁরা খুবই বিনীত এবং ভদ্র।
ঘরে ফিরে লিখতে শুরু করলেন, ‘সিংহল রাজ্যের যে সুমিত্র মহীপতি। সুমিত্রা তনয়া তাঁর অতি রূপবতী।। কন্যারে দেখিয়া রাজা ভাবে মনে মন। কন্যাযোগ্য বর কোথা পাইব এখন।। রাজচক্রবর্তী দশরথ লোকে জানে। রাক্ষস গন্ধর্ব্ব কাঁপে যাঁর নাম শুনে।। ব্রাহ্মণে ডাকিয়া রাজা কহিল সত্বর। দশরথে আন গিয়া অযোধ্যা-নগর।। ... শুনিয়া কন্যার কথা হৃষ্ট দশরথ।... কৌশল্যা কৈকেয়ী পাছে জানে দুই জন। মৃগয়ার ছলে রাজা করিল গমন।। নানা বাদ্যে দশরথ চলে কুতূহলে। উত্তরিল গিয়া রাজা নগর সিংহলে।।... দেখি দশরথের লাবণ্য মনোহর। লোকে বলে বিধি দিল কন্যাযোগ্য বর।।... গোধূলিতে দুই জনে শুভদৃষ্টি করে।’
বহু বছর পরে ও বহু দূরে বসে যখন নিজের ঘরে বসে জয়গোপাল সেই পঙ্ক্তিগুলো পড়েন, তর্কবাগীশ বাক্যহারা।
তর্কবাগীশ বললেন, ‘‘অতএব কৃত্তিবাসের মতে, সিংহলে রামের আগেই গিয়েছিলেন দশরথ। সিংহল তাই লক্ষ্মণের মামার বাড়ি। রাক্ষসদের কোনও প্রসঙ্গই এ ক্ষেত্রে ওঠেনি।’’
জয়গোপাল লণ্ঠনের আলোটি উস্কে দেন। তাতে তর্কবাগীশের যে ছায়া দেওয়ালে পড়ে, তাতে তাঁকে যেন রাক্ষসের মতো দেখতে লাগে। জয়গোপাল চিঁড়ে ভেজে তাতে সামান্য সরষের তেল আর নুন মেখে একটি পাত্রে ধরে সামনে রাখেন। তর্কবাগীশ সেই পাত্রের দিকে হাত বাড়ালে ছায়া দেখে মনে হয় যেন রাক্ষসের হাতই এগিয়ে আসছে। তর্কবাগীশ বলেন, ‘‘আর একটা কথা, বাল্মীকিতে সুমিত্রা দশরথের তৃতীয় নন, দ্বিতীয় স্ত্রী। রামায়ণে পরিষ্কার রয়েছে, রাম নিজে ভরদ্বাজের কাছে বলেছেন, ‘অস্যা বামভুজং শ্লিষ্টা যা সা তিষ্ঠতি দুর্মনাঃ। ইয়ং সুমিত্রা দুঃখার্তা দেবী রাজ্ঞশ্চ মধ্যমা।।’ অর্থাৎ, ‘কৌশল্যার বাঁ বাহু ধারণ করে যিনি দুঃখিত চিত্তে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তিনিই মহারাজের মধ্যমা মহিষী দেবী সুমিত্রা।’ আর কৈকেয়ী সম্পর্কে রামেরই মন্তব্য রয়েছে, ‘হে লক্ষ্মণ, রাজ্য পাওয়ার পথে বিঘ্ন ঘটায় কনিষ্ঠা মাতা কৈকেয়ীকে দোষ দিয়ো না।’ তবে রামায়ণে সুমিত্রার পিতৃবংশ সম্পর্কে পরিষ্কার করে কিছু বোঝা যায় না। কালিদাস লিখেছেন, সুমিত্রা মগধদেশের কন্যা। কেউ বলেন, তিনি কাশীর রাজকন্যা ছিলেন।’’
এ বার তর্কবাগীশ খুবই অবাক গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘‘কৃত্তিবাস এ সব জানতেন না, তা কিছুতেই হতে পারে না। তা হলে তিনি কী করে সুমিত্রাকে সিংহলরাজনন্দিনী তৈরি করলেন?’’ তর্কবাগীশ প্রশ্ন করেন, ‘‘তা ছাড়া, এ কোন গৌড়েশ্বরের সভা জয়গোপাল?’’
কিঞ্চিত উত্তেজিত জয়গোপাল বলেন, ‘‘একটা কথা বুঝতে পারছ না? কৃত্তিবাস জেনেশুনে বাল্মীকির কাব্যে নিজের কালের স্বাক্ষর যোগ করছেন। সেই সমসময়ের চিহ্ন ধরছেন কাব্যের একেবারে গোড়ায়। সেই দশরথের বিবাহের কাহিনি থেকেই।’’
জয়গোপাল বললেন, ‘‘আর তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হল, গোঁড়ামি থেকে মনে হতে পারে, স্বাধীন বাংলার নবাবদের মধ্যে হিন্দু রাজা গণেশ বা জমিদার কীর্তিনারায়ণ বা এমনই কোনও হিন্দু ভূপতির সময়েই কৃত্তিবাস রামায়ণ লিখেছিলেন। কিন্তু এই ভাবনাটা অন্যায়। এই যে ধরো খ্রিস্টান পাদ্রি উইলিয়ম কেরি, সে কেন রামায়ণ ছাপাল? কোম্পানি তাকে তো কিছু বললে না। এই যে এখনও মিশন রামায়ণ প্রকাশ করতে চায়, তাতে কি মনে হয় না, শাসকের কাছে ধর্মের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল শাসিতের বিশ্বাস অর্জন করা? তুর্ক শাসকদের ব্রাহ্মণ মন্ত্রীরা ছিলেন। তাই শুধু হিন্দু রাজা বা জমিদারই রামায়ণ লিখতে বলবেন, এমনটা আমি বিশ্বাস করি না তর্কবাগীশ।’’ তর্কবাগীশ বললেন, ‘‘তবে নানা মুনির নানা মত তো রয়েছে।’’
জয়গোপাল উঠে জানলার কাছে গেলেন। বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘কৃত্তিবাসকে আগে চেনো তর্কবাগীশ। কৃত্তিবাস নিজের পছন্দ এবং অননুমোদন দুই-ই গোপন রাখছেন না। কৃত্তিবাস লিখছেন— ‘সুমিত্রার রূপে নৃপ মদনে মোহিত। অধৈর্য্য হইয়া প্রায় হইল মূর্চ্ছিত।। বিলম্ব না সহে রাজা করে ইচ্ছাচার। রথের উপরে রাজা করেন শৃঙ্গার।।’’’
তর্কবাগীশ তড়িঘড়ি উঠে এক ঘটি জল খেয়ে নেন। জয়গোপাল বললেন, ‘‘চমকে উঠো না। দেখো, কাহিনির সঙ্গে লেখকের একটি দ্বৈরথ কখনও কখনও হয়। তখন লেখকের নিজস্ব শক্তি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। সেই শক্তিতে সে অনেক অনতিক্রম্যকে পার করে যায়। এমন একটি মায়া রচনা করতে পারে, যাতে অবিশ্বাস্য বিশ্বাসযোগ্য হয়।’’
তর্কবাগীশ বলেন, ‘‘কিন্তু তারও একটা শৃঙ্খলা তো থাকবে?’’ জয়গোপাল হেসে বললেন, ‘‘রামায়ণ স্মৃতিশাস্ত্র ও ধ্রুপদি কাব্য। কৃত্তিবাস বেশ খানিক স্বাধীনতা নিচ্ছেন। কিন্তু দেখো, এই বিবরণে লেখকের প্রতিষ্ঠা ঘটছে কী ভাবে! তিনি ‘ইচ্ছাচার’ বলায় মনে হচ্ছে, কৃত্তিবাস তা অনুমোদন করছেন না, কিন্তু বিবৃত করছেন। এ বার কথা হল, বাল্মীকি তা অনুমোদন করতেন কি না! মনে হয়, করতেন না। বাল্মীকির কাব্য ধ্রুপদী সাহিত্য। তাতে এমন কিছু হওয়া শক্ত। মহাভারতে মনে করো, সত্যবতীর সঙ্গে পরাশরের মিলন হয়েছিল প্রকাশ্য নদীবক্ষে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে পরাশরের মাধ্যমে লেখক ব্যাস চারপাশে একটি কুয়াশা তৈরি করে দেন। সে মায়া লেখকের হস্তক্ষেপ। লেখকের ইচ্ছেয় কখনও দৈব, কখনও কোনও চরিত্রের বিশেষ শক্তি, কখনও প্রকৃতি সেই মায়া রচনা করে। তাই পরাশর-মৎস্যগন্ধা কাব্যের শক্তি ও শর্তে একটি আড়াল পেয়ে যান। লেখক চান তাঁদের আড়াল দিতে। অথচ, এখানে কাব্যের শক্তি ব্যবহার করে সেই মায়াটি তৈরি করার দিকেই ঘেঁষলেন না কৃত্তিবাস। তিনি সোজা করে বলে দিলেন। তোমার মনে পড়ে, মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেবীর পান করে মত্ত হয়ে যাওয়ার কথা? সেখানেও সোজা করে বলা রয়েছে। আমার প্রশ্ন, সেইটিই কি পুরাণকার চাইছিলেন? দেবী তাঁর চরিত্রই তো বটে!’’
তর্কবাগীশ প্রশ্ন করলেন, ‘‘অর্থাৎ, তোমার মতে কৃত্তিবাসের রাম কৃত্তিবাসেরই নির্মিত চরিত্র। তার আগে যে সর্বজনীন রাম ছিলেন, তিনি নন। তবে পুরাণকার সমাজকে প্রভাবিত করেন, সমাজকে অবশ্য করে মানেনও। এখন প্রশ্ন, কৃত্তিবাসের গৌড়েশ্বর কে ছিলেন?’’
দু’জনে ঘর থেকে বেরোলেন রাস্তায়। জয়গোপাল বলতে থাকেন, ‘‘ইংরাজির চোদ্দোশো পঞ্চাশ সালে সুলতান নাসিরুদ্দিন মহম্মদ শাহ গৌড়ে নূতন রাজধানীর প্রাসাদ থেকে শুরু করে শহরের নকশা নিজে স্থির করেছিলেন। বুদ্ধিমান ও স্থিতধী নবাব ছিলেন। দেশে তখন শান্তি ছিল। কৃত্তিবাস নিজেই কতটা পথ গিয়ে তবে গৌড়ে পৌঁছন। পথে কোনও বিপদের কথাও তিনি বলেননি। খুলনা, যশোর, ময়মনসিংহ, সিলেট থেকে শুরু করে সেই ভাগলপুর পর্যন্ত নিজের অধিকারে এনেছিলেন নাসিরুদ্দিন। মনে হয় না তর্কবাগীশ, এই সুলতানটি নিজেও নতুন কিছু করতে চাইছিলেন? শুধু রাজধানীর কয়েকটি প্রাসাদ বা সেতু তৈরি করেই থামতে চাননি? চেয়েছিলেন সংস্কৃতির একটি সেতুও তৈরি করতে? তাঁর সন্তান রুকনুদ্দিন বারবক শাহের আমলে সাহিত্যে জোয়ারের টান এল, তা এসেছিল কী করে, যদি সেই ধারা নাসিরুদ্দিন মহম্মদ শাহের কাছ থেকে প্রশ্রয় পেয়ে পুষ্ট না হয়?’’
তর্কবাগীশ দাঁড়িয়ে পড়েন রাস্তায়। বললেন, ‘‘তুমি কী বলতে চাইছ?’’
জয়গোপালও দাঁড়ালেন। বললেন, ‘‘পণ্ডিত, সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতম্-এর রাম কার আদর্শে নির্মিত?’’ তর্কবাগীশ স্তম্ভিত হয়ে বলেন, ‘‘অনেকে বলেন বৌদ্ধ রাজা রামপালের আদর্শে।’’ জয়গোপাল বলেন, ‘‘তবে?’’ তার পরে সামান্য হেসে এগিয়ে যান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy