ছোটদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ। ফাইল ছবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, ‘ছেলেরা যে-বই পড়িবে তাহার কিছু বুঝিবে এবং কিছু বুঝিবে না, এইরূপ বিধান থাকা চাই। আমরা ছেলেবেলায় একধার হইতে বই পড়িয়া যাইতাম। যাহা বুঝিতাম এবং যাহা বুঝিতাম না দুইই আমাদের মনের উপর কাজ করিয়া যাইত’। রবীন্দ্র-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের ছোটোদের জন্য লেখাগুলি শুধুই ছোটোদের জন্যই নয়। আবার অন্য দিক থেকে তাঁর বড়দের জন্য লেখার বেশ কিছু গল্প খুব সহজে ছোটোদের মন জয় করে নেয়, যেমন ‘ইচ্ছাপূরণ’ বা ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’। ১৮৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মের আগে থেকেই শিশুদের জন্য সাহিত্যের ভাবনাচিন্তার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে শিশুগ্রন্থ ‘নীতিকথা’ এবং ১৮২০ সালে ‘হিতোপদেশ’ নামের শিশু পুস্তকটি।
শিশু সাহিত্যেকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অবদান অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথের পরিবারের লক্ষ্য ছিল ছোটোদের সাহিত্যমুখী করে তোলা। ছোটোদের জন্য লেখাই শুধু নয়, ছোটোদের দিয়ে লেখানোর তাগিদটা তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন। ফলে, ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানদানন্দিনীর সম্পাদনায় শুরু হল ছোটোদের জন্য পত্রিকা ‘বালক’। এই পত্রিকায় এক দিকে, যেমন বড়রা লিখেছেন, তেমনই লিখেছেন কিশোর, কিশোরীরা। ১৮ বছরের হিতেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন একটি গল্প, ‘বারো আনা ষোলো আনা’। কৈশোর অবস্থায় ‘বালক’ পত্রিকার জন্য লিখেছেন স্বর্ণকুমারিদেবীর দুই কন্যা— হিরণ্ময়ী ও সরলা। লিখেছেন দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র সুধীন্দ্রনাথ। এ ভাবেই ভবিষ্যতের লেখক তৈরির প্রয়াস তৈরি হল। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, সম্পাদক জ্ঞানদানন্দিনী তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন ‘বালক’-এ লেখার জন্য। যার ফলশ্রুতি হিসেবে দেখা যায়, প্রথম সংখ্যার ‘বালক’-এ প্রকাশিত ১৩টি লেখার মধ্যে পাঁচটিই ছিল রবীন্দ্রনাথের।
প্রথম পৃষ্ঠায় লিখলেন, ‘দিনের আলো নিবে এল,/ সুয্যি ডোবে - ডোবে।/ আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে/ চাঁদের লোভে লোভে।’ বালকের প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হল কিশোরদের জন্য ত্রিপুরার রাজকাহিনিকে কেন্দ্র করে ‘মুকুট’ নামের বড়গল্প। বালকের তৃতীয় সংখ্যা থেকে ধারাবাহিক ভাবে লিখলেন ‘রাজর্ষি’। অকারণে রক্তপাত, স্বার্থ এবং লোভের জন্য হানাহানি এই সবকিছুই তিনি লিখেছিলেন সহজ অথচ শৈল্পিক চিন্তাধারার সংমিশ্রণে যা ছোটোদের বুঝতে একটুও অসুবিধে হয়নি। এ ছাড়াও ছোটোদের জন্য লিখলেন নাটক, ঐতিহাসিক কাহিনি। এ ভাবেই শুরু হল ঠাকুরবাড়ির শিশু সাহিত্যচর্চা। যদিও ‘বালক’ এক বছর পরেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ‘বালক’ চলাকালীন তরুণ রবীন্দ্রনাথ তাঁর মেজ বৌঠাকুরানির ‘সহচরী’ হয়ে সম্পাদনা এবং প্রকাশনার বহু দিক সামলাতেন। ‘বালক’-এ রবীন্দ্রনাথের লেখার ধরন নতুন এক ভাবনার সূচনা করেছিল। বোঝা গিয়েছিল, ছোটদের জন্য লেখা মানেই ‘ছেলেমানুষি’ নয়, রীতিমতো সচেতন ভাবে কল্পনাকে উস্কে দেওয়াই হল শিশু সাহিত্যের মূল উদ্দেশ্য।
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মেজবৌঠাকরুরানি জ্ঞানদানন্দিনীর কথা উঠে আসে। যিনি জহুরির চোখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাহায্য নিয়েছিলেন শিশু সাহিত্যের উন্নতির জন্য। নিজেও ছোটোদের জন্য লিখেছিলেন চলিত ভাষায় ‘টাকডুমাডুম’ ও ‘সাতভাই চম্পা’ নামের দু’টি নাটক। সে যুগে এই ধরনের চলিত ভাষা লেখা একেবারেই অভাবনীয়।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘কালের ধর্মই এই। মর্তলোকে বসন্ত ঋতু বসে থাকে না। মানুষের ক্ষমতার ক্ষয় আছে, অবসান আছে।’ এই কালের ধর্ম অনুসারেই ঠাকুরবাড়িতে শুরু হল শিশুদের জন্য বা ছোটোদের জন্য নতুন নতুন ভাবনা চিন্তা। কলম ধরলেন পরিবারের অনেকেই। মোহনলাল ও শোভনলাল ভাইয়েরা ছোটদের জন্য লেখা শুরু করেন এবং মোহনলাল অচিরেই শিশু সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর ‘বাবুইয়ের অ্যাডভেঞ্চার’ ও ‘বোর্ডিং ইস্কুল’ উপন্যাস দু’টি উল্লেখযোগ্য।
ঠাকুরবাড়ির শিশু সাহিত্যের কথায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম না এলে তা হবে অসম্পূর্ণ। তার গল্প বলার দক্ষতা দেখেই রবীন্দ্রনাথ তাকে লিখতে অনুরোধ করেন। এবং লেখার ব্যাপারে নির্দেশ দেন, লেখার মধ্যে যেন গল্প বলার ঢংটি বজায় থাকে। রবি-কাকার অনুপ্রেরণায় অবনঠাকুর মিষ্টি গদ্য লিখলেন না বলে, আঁকলেন বলাই শ্রেয়। তার ক্ষীরের পুতুল গল্পটির আধার ছিল রবীন্দ্র-পত্নী মৃণালিনীদেবীর রূপকথা খাতার এক গল্পে। ‘বুড়ো আংলা’র উৎস ছিল সুইডিশ এক কাহিনিতে।
রবীন্দ্রনাথের ‘শিশু ভোলানাথ’ ১৩২৯ সালে গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এই পুস্তকের অনেক কবিতাই ‘মৌচাক’, ‘প্রবাসী’, ‘সন্দেশ’, ‘বঙ্গবাণী’, ‘রংমশাল’, ‘শ্রেয়শী’ ইত্যাদি সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘সময়হারা’ কবিতাটি ১৩৩০ বৈশাখের সন্দেশ পত্রিকা থেকে ‘শিশু ভোলানাথ’ গ্রন্থে (১৩৫০) এবং রচনাবলী সংস্করণে (১৩৪৯) নতুন করে সংকলিত হয়। ‘শিশু ভোলানাথ’ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পশ্চিম-যাত্রীর ডায়েরি’তে লিখছেন, ‘ঐ শিশু ভোলানাথের কবিতাগুলো খামকা কেন লিখতে বসেছিলুম? সেও লোকরঞ্জনের জন্য নয়, নিতান্ত নিজের গরজে’। আবার এও লিখেছেন, ‘অন্তরের মধ্যে যে শিশু আছে তারই খেলার ক্ষেত্র লোকে লোকান্তরে বিস্তৃত। এইজন্য কল্পনায় সেই শিশুলীলার মধ্যে ডুব দিলুম, সেই শিশুলীলার তরঙ্গে সাঁতার কাটলুম, মনকে স্নিগ্ধ করবার জন্য, নির্মাণ করবার জন্য, মুক্ত করবার জন্য’। ছোটোদের জন্য আন্তরিক এক টান থেকে রচনা হয়েছিল ‘শিশু ভোলানাথ’। প্রকৃতি এবং শৈশবকে মিশিয়ে তাঁর রচনা, ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/ সব গাছ ছাড়িয়ে/ উঁকি মারে আকাশে।’ শিশু ভোলানাথের অন্য কবিতাগুলির মধ্যে ‘বুড়ি’, ‘রবিবার’, ‘পুতুল ভাঙা’ ‘রাজা ও রানী’ শিশু সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থ মোহিতচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ১৩১০ বঙ্গাব্দে। রবীন্দ্রনাথের পত্নী মৃণালিনীদেবীর মৃত্যুর পরে, কবি তাঁর মধ্যম কন্যা রেনুকা-সহ প্রথমে হাজারিবাগ পড়ে আলমোড়ায় গিয়েছিলেন। মীরা ও শমীন্দ্রনাথকে মেজো বৌঠানের কাছে রেখে গেছিলেন। ‘শিশু’র কিছু কবিতা মাতৃহীন পুত্রকন্যাদের স্মরণ করে রচনা করেছিলেন ৫ শ্রাবণ থেকে ৬ ভাদ্রের মধ্যে (১৩১০)। রবীন্দ্রনাথ ‘শিশু’র অনেক কবিতা তিনি ইংরাজিতে অনুবাদ করেছিলেন ১৯১৩ সালে ‘দ্য ক্রিসেন্ট মুন’ গ্রন্থে। এ প্রসঙ্গে ‘ডাকঘর’ নাটকটির কথাও বলা চলে। ১৯১৩ সালে লন্ডনে এ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ যখন মঞ্চস্থ হয়, দর্শকাসনে ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এ ক্ষেত্রে ভুলে যাওয়া যায় না ‘সহজপাঠ’-এর কথা। ১৯৩০ সালের ১০ মে প্রকাশিত হয়। সহজপাঠের প্রথম ভাগে বাংলা বর্ণমালা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারনা এবং দ্বিতীয় ভাগে বাক্য, শব্দের ব্যবহার সহজ করে শেখানো। সরল ছন্দের মিশ্রণ এবং শৈল্পিক শব্দের বিন্যাসে শৈশবের চমৎকার সূচনা। নন্দলাল বসুর ছবি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শব্দমালায় সহজপাঠ, অচিরেই হয়ে ওঠে ছোটদের পড়া পড়া খেলা।
আসানসোলের সাহিত্য সংস্কৃতি কর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy