দুর্গাপুর ব্যারাজের একটি লকগেট ভাঙিবার ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হইল। নানা প্রযুক্তিগত কারণে মেরামত শুরু হইতে যত বিলম্ব হইয়াছে, তীব্র জলাভাবে নগরবাসীর কষ্ট ততই দীর্ঘায়িত হইয়াছে। পাড়ায় পাড়ায় ট্যাঙ্কার পাঠাইয়া, জলের পাউচ বিলি করিয়াও চাহিদা মিটাইতে পারে নাই পুরসভা। জলের কালোবাজারি হইয়াছে, করোনাবিধি ভুলিয়া কাড়াকাড়ি করিয়া জল সংগ্রহ করিয়াছেন নগরবাসী। ৩১ অক্টোবর ব্যারাজ ভাঙিয়া ভাসিয়া গিয়াছে নৌকা, মাছ ধরিবার জাল। মেরামত করিবার জন্য পাঁচটি গেট খুলিয়া দিয়া অবিরাম ব্যারাজ-বিধৃত জল বাহির করা হইয়াছে, তাহাতে দামোদরের শুষ্ক নদীখাত প্রকট হইয়াছে। সেই সঙ্গে দেখা দিয়াছে কয়েকটি প্রশ্ন। এই সঙ্কট কি এড়ানো যাইত না? ২০১৭ সালে এক বার ব্যারাজের গেট ভাঙিয়াছিল, সে বারও এমনই জলকষ্টে ভুগিয়াছিলেন নগরবাসী। গত বৎসর মুখ্যমন্ত্রী ২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুর্গাপুর ব্যারাজ সংস্কারের কথা ঘোষণা করিয়াছিলেন। সংবাদে প্রকাশ, সে কাজ শুরুও হইয়াছে। কিন্তু বিপত্তি আটকানো যায় নাই।
বাঁধ ভাঙিবার কারণ অজানা নহে। সাড়ে ছয় দশক ধরিয়া দুর্গাপুর ব্যারাজের গেটগুলি বদলানো হয় নাই। পলি এবং জলের প্রবল চাপে পুরাতন গেটগুলি বিপন্ন। দামোদরের বন্যা হইতে বাংলার জেলাগুলিকে আমেরিকার ‘টেনেসি ভ্যালি অথরিটি’-র অনুকরণে ১৯৪৮ সালে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (ডিভিসি) গড়িয়া উঠে। মাইথন, তিলাইয়া, তেনুঘাট, পাঞ্চেত এবং কোনারে বাঁধ তৈরি হইলেও, এই প্রকল্পের একমাত্র ব্যারাজটি দুর্গাপুরে গড়িয়া তোলা হয় ১৯৫৫ সালে। সার্বিক সংস্কারের দাবি বহু বার উঠিলেও কাজ হয় নাই। উপরন্তু, সেচ ও পানীয় জলের জন্য ব্যারাজ-সংলগ্ন জলাশয় এবং ‘ফিডার ক্যানাল’-ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পানায় পূর্ণ। পানীয় জলের জোগান দিবার ক্যানালটির লকগেট আট বৎসর ধরিয়া বিকল। আক্ষেপ, বাঁধের স্বাস্থ্য অবহেলার ফলে দুর্ঘটনার এই চিত্র বিরল নহে। স্বাধীনতার পরে চল্লিশটি বাঁধ ভাঙিয়া ক্ষয়ক্ষতি হইয়াছে। ২০১০ সালে সংসদে বাঁধ সুরক্ষা আইন করিয়া জাতীয় স্তরের সংস্থা তৈরির প্রস্তাব আনিয়াছিল ইউপিএ সরকার। রাজ্যগুলি প্রতিবাদ করিয়াছিল, যে হেতু জল রাজ্যের বিষয়। ২০১৯ সালে ফের বাঁধ সুরক্ষা আইনের প্রস্তাব আসিয়াছে সংসদে।
রাজ্য সরকার প্রচলিত রীতি মানিয়াই সকল সমালোচনার উত্তরে ‘রাজনীতি’ না করিবার আবেদন করিয়াছে। কিন্তু জনস্বার্থের সহিত রাজনীতির সম্পর্ক যদি রক্ষা করিতে হয়, তা হইলে পানীয় জল ও সেচের জলের জোগান রাজনীতির বিষয় করিতে হইবে বইকি। কেন্দ্র ও রাজ্যের রাজনৈতিক সংঘাতে অনেক নদী সংস্কার ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের কাজ বিলম্বিত হইয়াছে। তাহার অন্যতম উদাহরণ ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান। শিলাবতী, কংসাবতী প্রভৃতি নদীর সংস্কার করিয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ করিতে এবং এলাকায় সেচ বাড়াইতে এই প্রকল্পের পরিকল্পনা হয় সত্তরের দশকে। তাহার অর্থ বরাদ্দ লইয়া কেন্দ্র ও রাজ্যের কাজিয়াতে আজও নদী সংস্কারের কাজ কিছুই হয় নাই। বর্তমানে রাজ্যের উদ্যোগে কিছু খাল সংস্কার হইতেছে। এমন চলিতে পারে না। এ রাজ্যের প্রধান বাঁধ ও ব্যারাজগুলির স্বাস্থ্য কী রূপ, তাহার মূল্যায়ন এবং সংস্কারের পরিকল্পনা এখনই জনসমক্ষে পেশ করা প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy