প্রতীকী ছবি।
সম্প্রতি দিল্লি সরকারের একটি ঘোষণা নিয়ে বিশেষ শোরগোল দেখা দিয়েছে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল বলেছেন যে, তিনি মেয়েদের জন্য বাস এবং মেট্রো ভাড়া মকুব করবেন। অনেকেই বলছেন, এই পদক্ষেপ আসলে লিঙ্গসাম্য খণ্ডন করছে। মেয়েরা কি ভিখারি নাকি? মেয়েদের আত্মসম্মান নেই? যদি গাড়িভাড়া মকুব করতেই হয়, তবে ছেলেদেরও করা হোক। নিম্নবিত্ত ছেলেদেরও কাজে যাওয়ার ভাড়া থাকে না অনেক সময়।
প্রাথমিক ভাবে এই যুক্তিগুলো মানতেই মন চায়। কিন্তু একটু গভীরে গেলেই সারি সারি মুখ মনে ভেসে ওঠে। ধরা যাক নীতার কথা। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে আসে সে। বাড়ি নোনাডাঙায়। যাদবপুর আসতে তার প্রতি দিন ৫০ টাকা গাড়িভাড়া লাগে। নীতার স্বামী ভ্যান চালায়, দুই ছেলেমেয়ে পাড়ার স্কুলে পড়ে। শুধুমাত্র গাড়িভাড়া জোগাড় করতে পারে না বলেই নীতা প্রায়শই ট্রেনিং কামাই করে। এমতাবস্থায় নীতাকে যদি বাসে ভাড়া দিতে না হয়, তা হলে সে নিয়মিত আসতে পারবে এবং দ্রুত প্রশিক্ষণ শেষ করে ড্রাইভারের চাকরি করবে। তার হাতে দুটো পয়সা এলে নিজের প্রয়োজন ও ইচ্ছেমতো খরচ করতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ নীতার মতো মেয়েদের বাসভাড়া মকুব হলে তাদের রোজগারের সুযোগ বাড়বে এবং রোজগারের ওপর নিয়ন্ত্রণও বাড়তে পারে। দেশে মেয়েদের অর্থকরী কাজে অংশগ্রহণ ২০০৪-এ ৩৪% থেকে কমতে কমতে ২০১৪-য় ২৭%-এ এসে ঠেকেছে— তাই এই পদক্ষেপের হয়তো একটা আলাদা অর্থ আছে।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও বহু মেয়েকে একই কারণে কলেজ ছেড়ে দিতে হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার গ্রামগুলিতে দেখেছি, কলেজপড়ুয়া মেয়েদের বন্ধুদলে এক জন সপ্তাহে এক দিন কলেজ যায়। যে দিন যে কলেজে যায়, সে দিনের নোট সে বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে পড়ে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সবাই রোজ কলেজ যাও না কেন? উত্তর ছিল, “বাবা গাড়িভাড়া দিতে পারে না, দিদি।”
যুক্তি হতে পারে, দরিদ্র ছেলেদেরও তো একই দশা। বহু ছেলেকেই পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণ ছেড়ে দিতে হয় অর্থাভাবে। ঠিক কথা। দরিদ্র পরিবারের ছেলেদের জন্যও যদি বিনা ভাড়ার পরিবহণের ব্যবস্থা করা হয়, তা হলে খুবই ভাল হয়। কিন্তু এখানে একটা অন্য কথাও আসে। পরিবারের খরচের ধরনে যে লিঙ্গবৈষম্য চোখে পড়ে, সে কথাও বিবেচনা করা দরকার। অধিকাংশ পরিবারেই মেয়ের বিয়ের পণের জন্য টাকা জমানো আর ছেলের উচ্চশিক্ষা অথবা কারিগরি প্রশিক্ষণের জন্য ব্যয়বরাদ্দ করা আজও আমাদের সংস্কৃতি। মেয়েরা যদি বিনা ভাড়ায় উচ্চশিক্ষা বা পেশাগত প্রশিক্ষণে যোগদানের সুযোগ পায়, তা হলে এই পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির মোকাবিলা সম্ভব। পরিবারের খরচের ধরনে যে লিঙ্গবৈষম্য আছে, তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মেয়েরা সফল পেশাদার হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে সক্ষম হবে, উচ্চশিক্ষাতেও তাদের জয়ধ্বজা উড়বে।
অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারেও মেয়েদের স্বামী, বাবা বা দাদার কাছে গাড়িভাড়ার জন্য হাত পাততে হয় বলে তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত হয়। বহু পরিবারে মাসের শেষে গৃহিণীকে হিসেব কষে বাড়ির বাইরে পা রাখতে হয়। অনেক পরিবারেই স্বামী স্ত্রীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য হাতখরচের টাকা মেপে দেয় এবং নিয়মিত সেই টাকার হিসেব নেয়। যদি স্ত্রী ‘অকারণ’ পথে বেরিয়ে গাড়িভাড়া খরচ করে, তা হলে কপালে নির্যাতন পর্যন্ত জোটে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের সুযোগ এবং ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে রাখার অন্যতম উপায় হল তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ। অনেক সময়ই গাড়িভাড়ার অজুহাতে মেয়েদের বাড়ির বাইরে যাওয়া প্রতিহত করে পরিবার। যদি বাসভাড়া দিতে না হয়, তা হলে হয়তো মেয়েদের জন্য বাইরের জগতের দরজা খুলবে আরও। আর কে না জানে, মেয়েদের ঘরের বাইরে পা রাখা লিঙ্গসাম্য অর্জনের অন্যতম সোপান।
কাজে যোগদানের সময়ও মেয়েদের পরিবারের অনুমতি নিতে হয়। মেয়ে কোন কাজ করবে, বাড়ির থেকে কত দূরে কাজের জায়গা, কাজের সময় কী, এ সব বিষয়ে পরিবারের কাছে রীতিমতো জবাবদিহি করতে হয় মেয়েদের। অনেক সময়ই কাজের জায়গা বাড়ি থেকে দূরে হলে মেয়েকে শুনতে হয়, মাইনের অর্ধেক তো বাস বা মেট্রোর ভাড়ায় বেরিয়ে যাবে, এমন কাজ করে লাভ কী! বহু কর্মরত মেয়েকেও মাসের শুরুতে তার পুরো মাইনে স্বামীর হাতে তুলে দিতে হয়। যদি তার নিত্য কাজে যাওয়ার গাড়িভাড়া মকুব হয়, তা হলে হয়তো সেই টাকাটা সে নিজের মর্জিমতো খরচ করতে পারবে।
কিন্তু মেয়েরা তো সরকারের কাছে এ দাবি তোলেনি। ঠিকই। কোনও আন্দোলন এখনও মেয়েদের বিনা ভাড়ায় পরিবহণের দাবি ওঠায়নি। এ-ও হয়তো সত্যি যে, কেজরীবাল সরকার আসন্ন ভোটের দিকে তাকিয়ে এই প্রকল্প ঘোষণা করেছে। কিন্তু পরিপ্রেক্ষিত যা-ই হোক, সুযোগ যখন এসেছে তখন তার সদ্ব্যবহারই সমীচীন। আর, লিঙ্গসাম্যের প্রশ্নে বিবেচনা করা দরকার, যে মানুষ বহু প্রজন্ম ধরে বঞ্চনার শিকার তাকে বিশেষ কিছু সুবিধা না দিলে সে কী ভাবে সাম্যের প্রতিযোগিতায় পাল্লা দেবে? উন্নয়নের আলোচনায় সাম্য (ইকুয়ালিটি) এবং সমতা (ইকুইটি) দু’টি ধারণার কথা বহুচর্চিত। সাম্য হল চূড়ান্ত লক্ষ্য, কিন্তু সাম্যে পৌঁছতে গেলে যে কখনও কখনও অন্ধের যষ্টির সাহায্য নিতে হয়। সাম্যের পথে যে অন্ধের যষ্টি লাগে তাকেই ‘ইকুইটি’ বলা যেতে পারে। মেয়েদের গাড়িভাড়া মকুবের মতো পদক্ষেপগুলি হয়তো আসলে সেই যষ্টি!
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy