প্রতিশ্রুতিই সার। আসানসোলে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, ১০ মে। ছবি: পিটিআই।
নরেন্দ্র মোদী দীর্ঘ মধুচন্দ্রিমা যাপন করছেন। জীবনের এই পর্বটিতে মানুষ সাধারণত দু’এক সপ্তাহ বেড়াতে যান, দারুণ কাটে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী দুনিয়াটাকে যত দ্রুত যত বেশি সম্ভব দেখে নিতে চাইছেন। প্রথম এক বছরের মধ্যেই তাঁর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ঘোরা হয়ে গেছে, তার সঙ্গে তিনি ঘুরে নিয়েছেন ভারত মহাসাগরের বুকে এমন কয়েকটি দেশ, পর্যটনের মানচিত্রে যেগুলি বিশ্ববিখ্যাত। এ বার তিনি চললেন চিন, মঙ্গোলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া সফরে। নরেন্দ্র মোদী যেখানেই গেছেন, বিরাট অভ্যর্থনা পেয়েছেন। সম্মানও। তার প্রধান কারণ তাঁর বিরাট নির্বাচনী সাফল্য এবং কাজের লোক হিসেবে তাঁর খ্যাতি। ভারত বরাবরই সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে পরিচিত, যে সম্ভাবনা শেষ অবধি অপূর্ণই থেকে যায়। বিশ্বের নানা দেশের নেতাদের ধারণা, মোদীর জমানায় এ বার ভারত আপন সম্ভাবনা চরিতার্থ করবে।
মোদীর নিজের দেশে কিন্তু এক বছরে উন্মাদনার পারদ অনেকটা নেমে এসেছে। এখনও এই কথাটা ভুলে যাওয়ার সময় হয়নি যে, মোদী এবং তাঁর বিজেপি এমন একটা জনাদেশ পেয়েছিলেন যা মোটেই গতানুগতিক নয়। নাগরিকদের প্রত্যাশা ছিল, দুর্নীতি, অপশাসন, মূল্যস্ফীতি এবং আর্থিক বদ্ধদশার ব্যাধি দূর করতে তিনি আমূল সংস্কার করবেন। িবরাট পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দিল্লির তখ্্তে তাঁর বছর ঘুরে এল, অথচ ভারত এখনও ‘অচ্ছে দিন’-এর প্রতীক্ষায় বসেই আছে। কিছু পরিবর্তন হয়নি এমন নয়। কিছু বিধি ও পদ্ধতির সংশোধন হয়েছে, কিছু আইন প্রণীত হয়েছে। কিন্তু এ-সবই হল দু’এক পা এগোনোর ব্যাপার। পালটে দেওয়ার মতো বড় কিছু ঘটেনি। মোদীর সমর্থকরাও অনেকেই এই গয়ংগচ্ছ অবস্থা দেখে একটু অবাক। অবশ্য তাঁর প্রচারকরা অবশ্যই এ কথা মানেন না। তাঁরা বলে চলেছেন, ভারত ইতিমধ্যেই পালটে গেছে, দুনিয়ার চোখে তার ভাবমূর্তিতে বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু এই ধারণা ধোপে টেকে না। ভারতবাসীর মতোই বিশ্বের নেতারাও মোদীর কাছে অনেক প্রত্যাশা করেন, তাঁর নির্বাচনী সাফল্যকেও তাঁরা সম্মান করেন, কিন্তু ভারত পালটে গেছে এমনটা তাঁরা মোটেই মনে করেন না।
সমস্যাটা কোথায়? মোদী জমানা কি সেই সব বৃত্তান্তের মতো, যেগুলি প্রথম একশো পৃষ্ঠার আগে শুরুই হয় না? না কি, এই জমানার আসলে কোনও প্লটই নেই? দ্বিতীয়টা ভাবতে ভয় লাগে, কিন্তু ক্রমশই মনে হচ্ছে, সেটার সম্ভাবনাই বেশি।
মোদী সরকার সংসদে যে আইনগুলি পাশ করানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন, সেগুলির কথা ধরা যাক। খেয়াল করতে হবে যে, গুরুত্বপূর্ণ বিলগুলি সবই মনমোহন সিংহের জমানার উত্তরাধিকার। যেমন বাংলাদেশের সঙ্গে স্থল-সীমান্ত চুক্তি, পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি), জাতীয় বিচারবিভাগীয় নিয়োগ কমিশন বিল। এগুলি পাশ করাতে আগের সরকার উদ্যোগী হয়েছিল, কিন্তু বিরোধীদের বাধায় পারেনি, যে বিরোধী শিবিরে প্রধান দল ছিল বিজেপি। এখনও পর্যন্ত মোদী সরকার নিজে একটিও গুরুত্বপূর্ণ বিল আনেনি।
দেখেশুনে মনে হয়, মোদী ও তাঁর সহযোগী নীতিকাররা কাজ করতে করতে শিখছেন। তাও নিতান্ত ধীরগতিতে। দেশের রকমারি সমস্যার মোকাবিলায় বুদ্ধিদীপ্ত বা নতুন ধরনের কোনও প্রস্তাব বিশেষ কোনও মন্ত্রক থেকেই আসেনি। সুরেশ প্রভু, অরুণ জেটলি, নিতিন গডকরী, এম বেঙ্কাইয়া নাইডু এবং পীযূষ গয়ালের মতো কিছু ব্যতিক্রমের কথা মনে রেখেই এটা বলা যায়। কেউ কেউ বলছেন, তাঁর পূর্বসূরিদের মতোই মোদী আমলাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। আমলাদের আটটি গোষ্ঠী তৈরি করা হয়েছে, অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের কর্তব্য নির্ধারণের জন্য তাঁরা ভাবনাচিন্তা করবেন এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতরে (পিএমও) সেগুলি পেশ করবেন। খেয়াল করা দরকার, এই প্রক্রিয়ায় রাজনীতির কোনও ভূমিকা থাকবে না। এটা একটু অদ্ভুত, কারণ একটা নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে সাধারণত উপর থেকে নীতি নির্ধারণ করা হয়, আমলারা সেই নীতি রূপায়ণ করেন। এই জমানায় সেটা বিশেষ ঘটছে না। আমলাতন্ত্রের ভূমিকা জোরদার হওয়ার পিছনে আর একটা ব্যাপার কাজ করেছে। মোদী নিজে আমলাদের এই আশ্বাস দিয়েছেন যে, তাঁরা নির্ভয়ে কাজ করতে পারেন, তাঁদের কাজ সহজ ও নিরুদ্বেগ করে তোলার জন্য আইনেও কিছু পরিমার্জন ঘটানো হয়েছে। যেমন, ভুল করে ফেলা এবং অসত্ উদ্দেশ্যে অন্যায় করার মধ্যে তফাত করার জন্য দুর্নীতি প্রতিকারের আইন সংশোধন করা হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের অনর্থক মামলার আশঙ্কা থেকে বাঁচানোর জন্যও রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সরকার নানা বিষয়ে নতুন বুদ্ধি খুঁজছে ঠিকই, কিন্তু অর্থনীতির স্বাস্থ্য উদ্ধারের কোনও বড় পরিকল্পনা তাদের মাথায় নেই। এখন দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হল বিনিয়োগের অভাব। এর প্রধান কারণ দুটি। এক, দেশে সঞ্চয়ের হার কম; দুই, বিদেশি বিনিয়োগ সীমিত। তার উপরে এক দিকে সরকার এবং অন্য দিকে কিছু প্রভাবশালী কর্পোরেট সংস্থা বিস্তর ঋণ নিয়ে চলেছে, ফলে বিনিয়োগের সীমিত তহবিলও ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। ওই সংস্থাগুলির কাছে ব্যাঙ্কের বিপুল বকেয়া, কিন্তু সেই কারণেই তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস ব্যাঙ্কের নেই।
এই মৌলিক সমস্যার মোকাবিলায় মন না দিয়ে অর্থমন্ত্রী রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের বিরুদ্ধে অনুযোগ করে চলেছেন, কেন তিনি সুদের হার কমাচ্ছেন না। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা (অস্তগামী) যোজনা কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তোপ দাগা আসলে দন কিহোতের হাওয়া-কলের সঙ্গে লড়াইয়ের মতোই, কারণ বিনিয়োগের সমস্যায় এদের কোনও ভূমিকা নেই। অন্য দিকে, মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগানটি প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রধান সমস্যা হল, ভারতে উত্পাদনের খরচ এখনও খুব চড়া এবং কেউই এ দেশে বিশেষ কিছু উত্পাদন করতে চায় না। স্লোগান দিয়ে এই সমস্যা মেটানো যাবে না।
মোদী সরকার যে সব পরিবর্তন আনছে, তার বেশির ভাগই প্রসাধনী। বারাণসীর ঘাট কিছুটা সাফসুতরো হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সে শহরের নর্দমাগুলো থেকে হাজার হাজার টন ময়লা গঙ্গায় ঢালা আগের মতোই চলছে। নোংরা ঘাট বারাণসীর আসল সমস্যা নয়, আসল সমস্যা হল বহু মানুষের ভয়ানক দারিদ্র, সীমিত কর আদায়, দুর্বল পরিকাঠামো এবং নাগরিক সচেতনতার তীব্র অভাব।
বস্তুত, সারা ভারতে এই একই সমস্যা। কী করে শহর পরিষ্কার রাখতে হবে, তা জানার জন্য কিয়োটোতে প্রতিনিধিদল পাঠানোর কোনও প্রয়োজন নেই। এই সমস্যার সমাধানের জন্য কতকগুলো মৌলিক সংস্কার চাই। সে-সবের কোনও লক্ষণ নেই, তাই যত দিন যাবে সমালোচকদের কণ্ঠস্বর ক্রমশ আরও চড়ায় উঠবে। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বিরোধীদের কিছু দিন স্তব্ধ করে রেখেছিল, কিন্তু সেই পর্ব এত দিনে কেটে গেছে। কংগ্রেস ভোটে গোহারান হেরেছে ঠিকই, কিন্তু তারা রাজনৈতিক শক্তি ইতিমধ্যেই অনেকটা পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে এবং সংসদে মোদী সরকারকে নাজেহাল করে ছাড়ছে। অন্য দিকে, বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে সরকার বিচারবিভাগের সঙ্গে টক্কর দিচ্ছে। আর আমলাতন্ত্র? একেবারে উপরমহল বাদ দিলে সেখানে বিশেষ কোনও রদবদল হয়নি। আমলারা সরকারি নীতিকারদের কাণ্ডকারখানা দেখে মজা পাচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম বছর ফুরিয়ে এল। এর পর মোদীর সমস্যা ক্রমশ বেড়েই চলবে। আশা করা যাক, তিনি এখনও আমাদের এবং দুনিয়াকে অবাক করে দিতে পারার ক্ষমতা রাখেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy