আমদাবাদে বক্তৃতা করার সময় নরেন্দ্র মোদী। ছবি: রয়টার্স।
প্রথম বার ভারতে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাংবাদিক সম্মেলন করলেন। সেটা কোনও আশ্চর্যের বিষয় নয়। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, সেই সম্মেলনে তিনি সাংবাদিকদের অনুরোধ করলেন তাঁকে প্রশ্ন করতে। এটাও সত্য যে, ট্রাম্প সাংবাদিকদের করা প্রশ্নের সোজা-সাপটা উত্তর সেই সম্মেলনে সর্বদা দেননি। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও মানতে হবে যে, ক্ষমতার উচ্চতম মিনারে অবস্থানরত এবং বিশ্বের সর্বত্র সংবেদনশীল ও বিবুধ সমাজে নিন্দিত ট্রাম্প নিজে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে শুনতে চেয়েছিলেন সম্মেলনের ডেস্কের ওপারে থাকা মানুষের কণ্ঠস্বর। এখানেই খিঁচ। ‘বন্ধু’ বলে যাঁকে সম্বোধন করে আলিঙ্গনের সময়ে যাঁর জওহরকোটের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে আক্ষরিক অর্থে ট্রাম্প যাঁর ‘পৃষ্ঠ-পোষণা’ করলেন, সেই মানুষটি, অর্থাৎ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঠিক কতটা অন্যপক্ষের কথা শুনতে আগ্রহী? কতটা আগ্রহী প্রশ্নের সম্মুখীন হতে? এমন এক সময়ে এই সম্মেলন ঘটছে, যখন রাজধানী দিল্লির একের পরে এক মহল্লা কাঁপছে সন্ত্রাসের ভয়ে, আক্রান্ত হওয়ার জুজু তাড়া করে বেড়াচ্ছে দেশের একটা লক্ষণীয় সংখ্যক মানুষকে, অনিকেত হওয়ার আতঙ্কে রাত কাটাচ্ছেন কয়েক লক্ষ মানুষ। এই সময়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এবং সেটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ধুরন্ধর ব্যক্তিত্বের পক্ষে অনুমান করাও কঠিন নয়। তবু তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্ন করতে বলেছেন। তিনি কতটা সেই সব প্রশ্নের সদুত্তর দিয়েছেন আর কতখানি পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন, তা নিয়ে বিতর্ক উঠতে পারে, কিন্তু এ বিষয়ে কোনও সংশয় নেই যে সেই সম্মেলনে কিছু ক্ষণের জন্য হলেও শ্রোতার ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
এইখানেই উঠছে আর এক প্রশ্ন, ট্রাম্প, যাঁকে ‘বন্ধু’ বলে ডাকলেন, সেই ব্যক্তি অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদী মহাশয়কে কি আদৌ কখনও শ্রোতার ভূমিকায় দেখা গিয়েছে? বরং মোদী-শাসিত ভারত তাঁকে ‘বক্তা’ হিসেবেই চেনে, জানে। মোদী একা নন, তাঁর দোসর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকেও ওই একই ভূমিকায় দেখা যায়। এই মুহূর্তে এ দেশে মাত্র দু’টি বর্গ—বক্তা ও ভক্তোঁ। এহেন বিভাজনে কোনও অসুবিধাই নেই, কারণ ‘ভক্তোঁ’-জনের সৃষ্টিই হয়েছে ‘দৈববাণী’ শ্রবণের জন্য। বক্তা এখানে ‘দেব’ (হর হর মোদী)। ভক্ত কেবল শ্রোতা ও নির্দেশ-পালক। প্রশ্ন এখানে অচল। প্রশ্ন এখানে অভব্যতা, অশালীনতা। মুশকিল এই যে, বক্তা নিজেকেও ‘দেবস্থান’-এই রাখেন বা দেখতে ভালবাসেন। ফলে একতরফা ভাবে তাঁর ‘মন কি বাত’ দেশসুদ্ধ লোক শুনতে বাধ্য, এটা তিনি মনে করেন। তাঁর দল মনে করে, দলের মগজ সঙ্ঘ মনে করে।
প্রশ্নকে মোদী এড়িয়ে যান, এই অনু্যোগকে যদি আমরা একটু অন্য আলোয় দেখতে চাই, তা হলে আরও কিছু ব্যাপার গুঁড়ি গুঁড়ি লাল পিঁপড়ের মতো কুট কুট করে কামড়াতে থাকে। সাংস্কৃতিক ভাবে ভারতীয়রা, মানে আধুনিক ভারতীয়রা, কতটা ‘শ্রোতা’? চুপ করে অন্যের মত শোনেন এমন লোকের সংখ্যাটা ঠিক কত? ভারত মাথায় থাক, বাঙালির পরমত-শ্রবণের ক্যাপাসিটি যাঁচ করতে বসলেই হেঁচকি উঠতে বাধ্য। যে শ্রবণ ও তর্কের জলবায়ু নৈয়ায়িক বাংলায়, ১৮ শতকেও টিকেছিল, তা ১৯ শতকে পশ্চিমি আধুনিকতার স্পর্শে হাওয়া হয়ে যায় এবং যুক্তিবাদের অবধারিত ফসল হিসেবে একবগ্গা বক্তার সমাজে পরিণতি পায়। যুগের হাওয়া ‘ভক্ত’-এর চরিত্র নির্ধারণ করে দেয়। ১৯ শতকে পশ্চিমি যুক্তিবাদী ‘ভক্তোঁ’-কুল কি একবারও ন্যায় বা নব্যন্যায়ের সঙ্গে সংলাপে রত হয়েছিল? নাকি নিজের গণ্ডির ভিতরেই নিজের খাপের লোকের সামনে গাঁক গাঁক করে সোশ্যাল রিফর্মের বাণী কপচে গিয়েছিল? মজা এইখানেই যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শিকড়চারণার সঙ্গে সঙ্গে সেই বাণীও ‘দৈব’ চরিত্র লাভ করে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে উঠে যায়। ভিন্নমতরা ‘পিছড়ে বর্গ’ হিসেবে প্রতিভাত হতে থাকেন। আজ আর কে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’-এ বাল্যবিবাহের সমর্থনে উত্থাপিত যুক্তির কথা ভাবে? উবে যেতে বসা ‘অনাধুনিক’ সমাজের কথা তখন কে-ই বা শুনতে চায়!
মার্কিন ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের সঙ্গে আমদাবাদে নরেন্দ্র মোদী। ছবি: রয়টার্স।
আরও পড়ুন: নীরবতা ভাঙলেন মোদী, দিল্লিতে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার আর্জি
সেই খেলা আজ অন্য মোড়কে হাজির। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সকলেই বক্তা। একা মোদীর দোষ দেখলে তো হবে না! যতই বলুন ফ্যাসিজমের প্রাইমারি লক্ষণ অন্যমত না-শোনা, ফ্যাসি-বিরোধীরা কতটা অন্যের মত শোনেন বা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে ভালবাসেন? স্তালিনের কথা বাদ দিন, তিনি তো সেই তাদেরই ষাঁড়ুভাই। কিন্তু নেহরু, ইন্দিরা গাঁধী, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য—কে কবে শ্রোতার ভূমিকায় থেকেছেন? ভারত তো শুধু বক্তারই দেশ। ফেসবুকে বাঙালি নিজের ডিপি-তে মাইক-মুখে ছবি রাখতে যতটা ভালবাসে, রয়্যালের বিরিয়ানিও বোধ হয় ততটা বাসে না। সারাদিন সারারাত জুড়ে নাড়ু-হারু-পঞ্চা-এলেম-জুলেম-জুলফক্কর তাদের ‘মন কি বাত’ আউড়ে চলেছে। ‘আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’ সকলেই, ‘কেহ’ শুধাইল কি শুধাইল না, তার তোয়াক্কা রাখি না। এখানে ‘মন কি বাত’-ই আসল। তা কেউ শুনল বা না শুনল, তাতে কিছু যায় আসে না।
মোদী সেই খাপের বাইরে নন। একদা ১৯ শতকীয় রিফর্মাররা যে বলটি গড়াইয়া দিয়াছিলেন, তাহা আজ অন্য রঙে রাঙিয়ে মোদী বা তদনুরূপেরা গড়াইতেছেন। সেই একই ‘প্রগতি’-র গল্প। ‘বেটার ডেজ’ তথা ‘অচ্ছে দিন’-এর মরীচি-মায়া। একদিন করব জয় নিশ্চয়। তদ্দিন কেবল তুমি শুনবে। সন্ধেবেলায় মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে গল্প করার গুজুগুজু নয় মামু, এ কেবল তুমি বলবে আমি শুনব-কেস। প্রগতির চক্করটাই ওই। একদলই কেবল তার গুপী গায়েন-বাঘা বায়েন। বাকি সব— ‘থেমে থাক’। যে বক্তৃতাবাজি একদা রিফর্মাররা করেছিলেন, তা আজ ডিগবাজি খেয়ে এমন কিছু লোকের হাতে, যাঁরা প্রগতির ঘড়িতে উলটো দিকে দম দিতে চান। অন্তত প্রগতিশীলরা তা-ই মনে করেন। কিন্তু ভেবে দেখুন, এঁয়ারাও ‘প্রগতি’-রই পক্ষে। কেবল এঁদের বেটার ডেজ আর অন্যপক্ষের বেটার ডেজের চরিত্র এক নয়। তলিয়ে ভাবলে দেখবেন, উভয়েই কিন্তু ‘সর্বাধিক সংখ্যক লোক’-এর ‘সব থেকে বেশি ভাল’-র কথা বলছেন। একদলের মতে সবথেকে বেশি লোক যাঁরা, অন্যদের মতে তাঁরা নন, অন্য কোনও জনগোষ্ঠী। তা হিন্দু হতে পারে, নাস্তিক হতে পারে, ইসলাম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-জৈন হতে পারে। কিন্তু ‘সবাই’ নন। ‘সেকু’-রা বলবেন ভারতের মতো দেশে ‘চাড্ডি’-রা থাকতেই পারেন না। ‘ভক্তোঁ’-রা বলবেন, ‘সেকু’-রা দেশ কে গদ্দার। কেউ কি কারওর কথা শুনল? অমিত শাহ কি শুনলেন শাহিন বাগের মহিলারা কী বলতে চান? জাকির নায়েকের ভিডিয়ো দেখে প্রাণীত যুবকটি কি বিপরীতের পুরো কথা ধৈর্য ধরে শুনছেন?
ইতিহাসবিদরা দেখিয়ে থাকেন, নয়া হিন্দুত্ববাদের জন্ম ১৯ শতকীয় রিফর্মেরই গর্ভে। সে ক্ষেত্রে এই একতরফা ‘বক্তা’ হয়ে ওঠা, ভিন্নমত না-শোনা বা প্রশ্নের সম্মুখীন না-হওয়াটাও সেইখান থেকেই জাত। মোদী কোনও এলিয়েন নন। মোহন ভাগবত আকাশ থেকে পড়েননি। রবীন্দ্রনাথ বা গাঁধীর আদর্শে এ দেশ যেমন নিজেকে গড়তে পারেনি, তেমনই ‘শ্রোতৃসমাজ’-ও তৈরি করতে পারেনি। তা হলে জনসভায় হাজার হাজার লোক কী করে? কার্যত তারাও সেখানে ‘বলে’। তাদের ‘মন কি বাত’ তাদের হয়েই তাদের নেতা আউড়ে যান মাইকে। তারা প্রশ্ন করে না, কারণ, এগুলো তাদেরই কথা। এখানে কে কোন পক্ষকে প্রভাবিত করে রেখেছে বলা কঠিন, নেতা না ভক্তোঁ—কে প্রথম কাছে এসেছে বলা যাবে না কোনও দিনই। কারণ এখানে কখন ভিত্তি নিজেই সুপারস্ট্রাকচার হয়ে দাঁড়ায়, বলা সত্যিই সম্ভব নয়। মোদীর ‘মন কি বাত’ তখন লাখোঁ ভক্তোঁ কি দিল কে ধড়কন। আর সেই পালসটাই মোদীকে চালায়। মোদীর পরের শাসককেও চালাবে।
আরও পড়ুন: দিল্লির সংঘর্ষে গোয়েন্দা অফিসারের মৃত্যু, চাঁদ বাগে নর্দমায় মিলল দেহ
তা হলে? ট্রাম্প কি দত্যিকুলে পেল্লাদ? সে কথা একেবারেই ভাববেন না। ট্রাম্পের এই ‘শ্রোতা’-র ভূমিকাটা মার্কিনি গণতন্ত্রেরই দস্তুর। সেখানে বিরোধীকে বলতে দেওয়া হবে, প্রশ্নবাণ সাগরভাইদের তোলা ‘রামায়ণ’ সিরিয়ালের তিরের মতো আকাশ আচ্ছন্ন করে থাকবে। কিন্তু উত্তর মিলবে না। ‘কত হাজার মরলে শেষে মানবে তুমি শেষে’— বলে বিলাপ করা ছাড়া সংবেদীদের সামনে, প্রকৃত অনুভবীদের কাছে অন্য কোনও দরজা খোলা থাকবে না। প্রতিবাদ হবে, গান হবে, কবিতা হবে, গিন্সবার্গ হবেন, বব ডিলান হবেন, জোন ব্যেজ হবেন, ব্রুস স্প্রিংসটিন হবেন। কিন্তু সেই সঙ্গে ভিয়েতনাম হবে, তাল বুঝে তালিবানকে মদত হবে, তালিবান ভস্মলোচন হয়ে উঠলে তাকে মারতে যুদ্ধবিমান উড়বে। কিন্তু কথা শোনা হবে। ‘গণতন্ত্র’ রক্ষিত হবে। সাংবাদিক সম্মেলনে তুলোধোনা হবেন শাসক। কিন্তু, উত্তর আসবে না। প্রকৃত উত্তর আসবে না কোনও দিনই। যেমন এদিন এনপিআর, এনআরসি আর উত্তাল পরিস্থিতি নিয়ে ট্রাম্প চমৎকার পাশ কাটিয়ে গেলেন “এসব ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার” বলে, সেভাবেই পাশ কাটিয়ে যবেন তাঁর উত্তরসূরিরাও। গ্যারান্টিড।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy