গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তজ্জনিত খাদ্য-সঙ্কট, হিন্দু-মুসলমানের বিষিয়ে ওঠা সম্পর্ক এবং এক শ্রেণির দেশীয় বানিয়ার প্রবল মুনাফাবাজ মানসিকতার ত্র্যহস্পর্শে বাংলার নাভিশ্বাস উঠছে। সেই দুর্দিনের কারিগরদের চিনে নিতে তৎকালীন নাগরিক বুদ্ধিজীবী সমাজের অসুবিধা হয়নি। তৈরি হয়েছিল ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সঙ্ঘ, শুরু হয়েছিল গণনাট্য আন্দোলন। নাট্য-আন্দোলনের কুশীলবরা গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে অভিনয় করতেন ‘ছেঁড়া তার’, ‘দুখীর ইমান’, ‘আগুন’। চটের ওপর রং করে তৈরি হত সিন, বাতিল জিনিসপত্র দিয়ে মঞ্চসজ্জা। যুগান্তকারী নাট্য-প্রযোজনাগুলো গ্রামে-গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল, শাসকের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসির বিরুদ্ধে গরিব, না-শিক্ষিত মানুষকে সচেতন করতে বিরাট ভূমিকা নিয়েছিল। শম্ভু মিত্র, তুলসী লাহিড়ি, বিজন ভট্টাচার্যদের সমবেত লড়াই কিন্তু শুধুই ‘সাংস্কৃতিক কাজকর্ম’ ছিল না, তা ছিল ক্ষমতাধর রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে এক গেরিলা যুদ্ধ। সে যুদ্ধে তাঁরা জিতেছিলেন না হেরেছিলেন সেটা বড় প্রশ্ন নয়। বড় কথাটা হল, তৎকালীন রাষ্ট্রশক্তিকে তাঁরা রীতিমতো বেগ দিতে পেরেছিলেন।
ইতিহাসের অমোঘ অনুবর্তনে আমরা প্রায় একই সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি আজ। এক দিকে জাতপাতের ব্যাধি, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ। অন্য দিকে সীমান্তে ঘনায়মান যুদ্ধ পরিস্থিতি। এ দিকে পেটেভাতের প্রশ্নে প্রায় দুর্ভিক্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দেশ। বাজারে পেঁয়াজ পঞ্চাশ টাকা, আদা সাড়ে তিনশো টাকা কিলো। লঙ্কা দেড়শো। সাধারণ মোটা চাল ত্রিশ। কাজের দিদি আক্ষেপ করছিলেন, তাঁকে আজ আদা ছাড়াই রান্না করতে হবে, কারণ দোকানদার দশ টাকার আদা দিতে রাজি হননি।
হিন্দিতে ‘নিয়ত্’ বলে একটা শব্দ প্রচলিত। ঠিক বাংলা হয় না, জোড়াতালি-অর্থ ‘আন্তরিক সদিচ্ছা’। এত কিছুর পরেও যে আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজ একজোট হচ্ছেন না, তেমন গর্জে উঠছেন না শাসকের বিরুদ্ধে, তার কারণ সম্ভবত তাদের ‘নিয়ত্ মে খোট হ্যায়’। অর্থাৎ ‘সদিচ্ছায় ভেজাল’। কথাগুলো মনে এল খুব সম্প্রতি কলকাতার এক নাট্যদলের প্রযোজনায় উৎপল দত্ত (ছবিতে)-এর নাটক ‘তিতুমীর’ দেখতে গিয়ে। ‘থিয়েটার ফর্মেশন পরিবর্তক’ নামের নাট্যদলটির কর্ণধার জয়রাজ ভট্টাচার্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর এই প্রযোজনা ‘কোনও রূপকের আড়ালে নয়, সরাসরি বিজেপির বিরুদ্ধে’। ভাল লেগেছিল সেই স্পষ্ট উচ্চারণ। ঘটনাচক্রে ‘তিতুমীর’ বাংলা ভাষার সেই হারিয়ে যাওয়া নাট্যধারার একটি উদাহরণ, যার সংলাপ অতি সহজ-সরল। স্পষ্ট। আঙ্গিকের দিক থেকেও যাত্রাপালার খুব কাছাকাছি। বিনোদনের মোড়কে লোকশিক্ষার কাজটিও এই জাতীয় নাটক চমৎকার ভাবে করতে পারে।
গণনাট্য-নবনাট্যের সেই দিনগুলোতে সান্ধ্য টেলি-সিরিয়াল বা বছরভর ক্রিকেট-বিনোদন ছিল না। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াতে গুজবের ব্যবহার হয়তো সে দিনও হত, কিন্তু গুজবকে প্রায় ইন্ডাস্ট্রির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ আদি সামাজিক মাধ্যমের সহায়তা সে দিনের শাসক পায়নি। সঙ্গে যোগ করুন পাকিস্তান-বিরোধী অতি-জাতীয়তাবাদী প্রচার, জনমানসে যা প্রায় হিস্টিরিয়া। একই মিথ্যা যখন মোবাইলে, টিভির পর্দায়, কম্পিউটার স্ক্রিনে হাজার বার হাজার মোড়কে সামনে আসতে থাকে, মন তাকে বিশ্বাস করে বসে। সেই মিথ্যার আড়ালে থাকা চক্রান্তটা মানুষকে বোঝানো, সত্যটা তুলে ধরা আজকের দিনে খুব কঠিন কাজ। মানুষ আজকাল জ্ঞানের কথা শোনে না, বই পড়ার অভ্যেস তলানিতে, সংবেদী নাটক-সিনেমাতেও রুচি নেই, তার মনোযোগের ব্যাপ্তি কমতে কমতে এখন মাত্র আট সেকেন্ডে এসে দাঁড়িয়েছে।
তাই আজও ওই গণনাট্য-নবনাট্যের পথই অনুসরণীয়। গ্রাম-গঞ্জের মানুষকে ‘তিতুমীর’-এর মতো নাটকগুলি দেখাতে হবে। লোকায়ত বিনোদনের মোড়কে চিনিয়ে দিতে হবে শাসকের চক্রান্ত। এ নাটকে তিতুমীর গ্রামের গরিব মুসলমানদের দাড়ি রাখার, শিবু-বিশু-গোপাল ইত্যাদি ডাকনামের বদলে নিজেদের ভারী মুসলমান নাম ধরে ডাকার নির্দেশ দেয়, কারণ ‘সে আসলে সেই চাষিকে পৃথিবীর বুকে দু’পা দৃঢ় ভাবে রেখে মাথাটা উদ্ধত ভাবে সোজা করতে শেখাচ্ছে’। আজকের ভারতে আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে ভোগা, সঙ্কুচিত হতে হতে ক্রমশ প্রান্তবাসী হয়ে পড়া সংখ্যালঘুদের জন্য তিতুমীরের সেই নিদান যে খুবই কার্যকর হতে পারে, তা আর নতুন করে বলার নয়। নাটকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেসিডেন্ট ক্রফোর্ড পাইরন বলেন, ‘কলকাতায় জোর প্রচার হওয়া চাই যে তিতুমীর হিন্দুর শত্রু, জাতনাশকারী, হিন্দু নারীর একনিষ্ঠ ধর্ষক, হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসকারী। সব সংবাদপত্রে লেখা চাই তিতু হিন্দু মন্দির দেখলেই তাতে গোমাংস ফেলছে।’ মনোযোগকে বিক্ষিপ্ত করার, মানুষে মানুষে বিভেদ বাধানোর সেই পুরনো পদ্ধতিই যে আজও একই ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা মানুষকে বোঝাতে পারবে এই রকম নাটকই। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চলতে থাকা, সংগঠিত এক মগজধোলাই কর্মসূচির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এটাই পথ। তত্ত্বকথা আউড়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না।
আমাদের রাজ্যের থিয়েটার-কর্মীরা নিজেদের সমাজ-পরিবর্তনের কান্ডারি ভাবতে ভালবাসেন। সে বিশ্বাসে যত না গণনাট্য-নবনাট্যের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হওয়ার অহঙ্কার আছে, ততটা আত্মনিবেদন নেই। ‘তিতুমীর’-এর মতো প্রযোজনা তাই আজ বেশি প্রয়োজন। কিন্তু শহুরে ইন্টেলেকচুয়ালদের প্রশংসার মোহ ত্যাগ করে, গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপ বা ধান-কাটা মাঠের ওপর বানানো অস্থায়ী মঞ্চে এ নাটক নিয়ে যেতে না পারলে শিল্পীদের ‘নিয়ত্’ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে, সে যতই তাঁরা ঘোষিত বিজেপি-বিরোধিতার কথা বলুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy