প্রমাণ: নাগরিকত্বের রাষ্ট্রীয় নথিতে নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তার প্রমাণপত্র হাতে। গুয়াহাটি, অসম। জানুয়ারি। ছবি:পিটিআই
দেশভাগের অনেক আগে থেকে গুয়াহাটির পান্ডু-মালিগাঁও অঞ্চল হয়ে ওঠে অভিবাসী বাঙালির প্রধান কেন্দ্র। রেলগাড়ি জাহাজ মালপত্র লোকজন হট্টগোলের মধ্যে পূর্ববঙ্গ থেকে সদ্য-আগতরা প্রচুর খুচরো কাজ খুঁজে পেতেন। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে পান্ডুতেই পুতুলকাকিমার জন্ম। কাকিমার বাপ-মা উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন পূর্ববঙ্গ থেকে।
পুতুলকাকিমার বিয়ে হয় দূর এক মফস্সলে।শ্বশুরবাড়িতে আরও দু’জন পুতুল ছিলেন। পদবির সঙ্গে কাকিমার নামও পালটে গেল— পুতুল গুহ থেকে কবিতা দাস। ২০১৫ সালে ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনশিপ (এনআরসি)-র লোকে যখন এসে খোঁজ করেছিল বাড়িতে কোনও অবৈধ বিদেশি থাকে কি না, কাকিমার বিয়ের আগের আর পরের কাগজে অসংগতি পাওয়া গেল। পুলিশ কাকিমাকে চটপট ডিটেনশন সেন্টারে চালান করে দিল। কাকিমার বয়স তখন ষাটের ওপর।
১৯৫১ সালে স্বাধীন ভারতে প্রথম জনগণনা করা হয়। তখন সমস্ত ভারতীয় নাগরিকের হিসেব নেওয়া হয়েছিল, এনআরসি-তে সেই তথ্য ঢোকানো হয়েছিল। হঠাৎ অসমে এনআরসি নবীকরণের দরকার কেন পড়ল? আশির দশকে অসমে বিদেশি বিতারণ আন্দোলন চলে, শেষ হয় ১৯৮৫ সালের অসম চুক্তিতে। স্থির হয়, ২৪ মার্চ ১৯৭১-এর পর অসমে আসা বিদেশিদের শনাক্ত করে বহিষ্কার করা হবে। বাস্তবে বহিষ্কারের কাজ বিশেষ এগোয়নি। একটা হিসেব বলছে, ১৯৮৫ সালের পর দুই দশকে হাজার দুয়েক লোককে বহিষ্কার করা হয়েছে।
অতএব, ১৯৮৫-র পরেও রাজনৈতিক প্রশ্ন হিসেবে ‘বিদেশি বহিষ্কার’-এর দাবিটি বেঁচে রইল। কিন্তু জনগণনার তথ্য দেখলে বোঝা যায়, ১৯৭১ সালের পর থেকে রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায় কম। অনুমান করা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পর সেই ভূখণ্ডে একটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ার ফলে ভারতে অভিবাসনের প্রবণতাও কমেছে। কিন্তু, রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ বা জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ কবেই বা তথ্য পরিসংখ্যানের তোয়াক্কা করেছে?
২০০৯ সালে একটি অসরকারি সংস্থা বিদেশিদের চিহ্নিত করে বহিষ্কারের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে। ২০১৪-য় এনআরসি নবীকরণের নির্দেশ দেয় আদালত। সিদ্ধান্ত হয়, ২৪ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত যাঁরা রাজ্যে এসেছেন, বা তাঁদের সন্তানরা, তালিকায় থাকবেন। বাকিরা বিদেশি গণ্য হবেন। এঁদের নাম দেওয়া হয়েছে ডি-ভোটার, ডাউটফুল ভোটার। ৩১ ডিসেম্বরের রাতে এনআরসি-র প্রথম খসড়া বেরিয়েছে। আবেদনকারীদের প্রায় ৫৮% প্রথম খসড়ায় আছেন। চূড়ান্ত তালিকা এখনও প্রকাশ হয়নি। যাঁরা খসড়ায় নেই, তাঁদের উৎকণ্ঠার পর্ব শুরু হয়েছে।
উৎকণ্ঠার কারণ কী? প্রথমে স্থানীয়দের কথা ধরা যাক। তাঁদের সবার সব কাগজ ঠিকঠাক থাকবে, তার নিশ্চয়তা কী? জনজাতি গোষ্ঠীর গরিব মানুষদের ক’জনের কাছে প্রামাণ্য দলিল দস্তাবেজ আছে যে তাঁরা বা তাঁদের বাপ-ঠাকুরদাদারা সাতচল্লিশ বছর আগে অসমে ছিলেন? এই উদ্বেগ ঠান্ডা করতে এনআরসি-র রাজ্য কো-অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলা বলেছেন, ‘কোনও প্রকৃত নাগরিক, মানে স্থানীয় কেউ, যাতে ডি-ভোটার তকমা না পান, তা দেখার দায়িত্ব আমার। আমি ব্যক্তিগত ভাবে চেষ্টা করেছি যাতে তালিকা বানানোর সময় সে রকম ভুলচুক না হয়।’
লক্ষ করুন, ‘প্রকৃত নাগরিক’ আর ‘স্থানীয়’র মধ্যে চমৎকার সমীকরণ টানা হল। প্রকৃত নাগরিক মানে সে স্থানীয়। বহিরাগতরা ১৯৭১-এর আগে এলেও তাঁদের পক্ষে প্রকৃত নাগরিক হওয়া সহজ নয়। স্থানীয়দের তুলনায় বহিরাগতদের উদ্বেগ কয়েক গুণ বেশি কেন, আন্দাজ করা যায়। আদালতে প্রমাণ করা গিয়েছিল, পুতুলকাকিমার জন্ম পঞ্চাশের দশকে পান্ডুতে হয়েছে। সবার সে সৌভাগ্য হয় না। আরও অনেক অভিবাসী মানুষকে তুচ্ছ কারণে, অকারণে হেনস্তা করা হয়েছে। আবার, বরাক উপত্যকায় বহু স্থানীয় আছেন যাঁরা বাংলাভাষী। হাজেলাসাহেবের আশ্বাস তাঁদের জন্য কি? না কি, বাঙালি আর বহিরাগতের মধ্যেও সমীকরণ আছে?
অসমে ভূমিপুত্র-সুরক্ষার রাজনীতি পুরনো। ইংরেজরা অসম দখল করার পর বহু দফায় বহু মানুষ অসমে এসেছেন। দেশভাগ এবং বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় উদ্বাস্তুর ঢল নামে। ইতিমধ্যে অসমিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি বেড়েছে, জাতীয়তাবাদী চেতনা বৃদ্ধি পেয়েছে। নিজের ভাষা, সংস্কৃতি হারানো নিয়ে বিপন্নতা বেড়েছে। শিক্ষা, ব্যাবসা, চাকরি, জমির মালিকানার ক্ষেত্রে বহিরাগতদের সঙ্গে কঠিন প্রতিযোগিতা ভূমিপুত্র-সুরক্ষার দাবিকে জোরদার করেছে। এই প্রেক্ষাপট মনে রাখলে বোঝা যাবে, কেন নবীকরণের প্রতি একাংশ মানুষের সমর্থন আছে। তাঁদের আশা, এ বার একটা হেস্তনেস্ত হবে।
পাশাপাশি, গত তিন দশকে গোটা দেশেই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। অসমের জোট সরকারের বড় শরিক বিজেপি। সরকারের অন্য শরিক অসমিয়া খণ্ডজাতীয়তাবাদী অসম গণ পরিষদ হিন্দু জাতীয়তাবাদের চড়া সুর মানতে মানতে চলেছে। মেনে নেওয়ার একটা নজির নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (২০১৬)। বিল অনুযায়ী পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুরা ভারতের নাগরিকত্বের জন্য যোগ্য, মুসলমানরা নন। বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় হুমকি দিয়েছিলেন, জোটসঙ্গী অগপকে এই বিল সমর্থন করতেই হবে। অগপ বিলটির ‘তীব্র বিরোধিতা’ করে দায় সেরেছে। আদর্শগত কারণে জোটত্যাগ? সে সম্ভবত অন্য সাধনার ফল।
এনআরসি-র এই তুমুল নাড়াচাড়ার ভবিষ্যৎ কী? দুটো সম্ভাবনা আছে। প্রথম সম্ভাবনা, খুবই কমসংখ্যক ‘বাংলাদেশি’কে চিহ্নিত করা গেল। তার দুটো সম্ভাব্য কারণ। এক, দুর্নীতির দৌলতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরাও এনআরসি-র তালিকায় ঢুকে পড়ল। দুই, খুব বেশি সংখ্যক বাংলাদেশি অসমে ছিলই না। কোনও সম্ভাবনাই উড়িয়ে দেওয়ার নয়। বিশেষত, জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭১-এর পর অসমে কখনও অস্বাভাবিক হারে লোকসংখ্যা বাড়েনি। নিশ্চিত ভাবেই প্রশ্ন উঠবে, এত হয়রানিতে মানুষের তবে লাভ কী হল?
দ্বিতীয় সম্ভাবনা, বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি ধরা পড়ল। প্রশ্ন, তাদের নিয়ে কী করা হবে? বাংলাদেশ অবৈধ অনুপ্রবেশের অস্তিত্বই স্বীকার করে না। ২০১৪-র ভোটের আগে মোদীজি আশ্বাস দিয়েছিলেন, বাংলাদেশিদের বিছানাপত্তর বেঁধে বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু কূটনৈতিক স্তরে বাংলাদেশের সঙ্গে এই বিষয়ে কথাবার্তা এগোয়নি, যদিও সুপ্রিম কোর্ট সে রকম নির্দেশ দিয়েছিল। বাংলাদেশ যদি এই মানুষগুলিকে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করে, তখন তাদের রাখবেন কোথায়? না কি, তাদেরও ভাগ্য হবে রোহিঙ্গাদের মতোই?
প্রশ্নগুলো এত বিপজ্জনক যে কাণ্ডজ্ঞান বলবে, এনআরসি তৈরি করে প্রকৃত আর ‘নকল’ নাগরিক বাছাইয়ের আগুন নিয়ে না খেলাই ভাল। কিন্তু, বিজেপির উৎসাহ প্রবল। কেন? একটা কারণ মতাদর্শগত। রাতদিন নাগরিকত্বের অনুশীলন ও জেনোফোবিয়া বা বিদেশি-ভীতি উগ্র-জাতীয়তাবাদী রাজনীতির খুঁটি। আধার কার্ড, নোট বাতিল, এনআরসি— গত ক’বছরে অনুষ্ঠিত যাবতীয় মহাযজ্ঞের একটা সাধারণ ধর্ম হল, প্রতিটিই আমাদের কলার ধরে ঝাঁকিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে যোগাযোগের কথা মনে করায়। ‘বৈধ’ আর ‘অবৈধ’র মধ্যে নিত্যনতুন গণ্ডি টানে। জনতা এখন আর রাষ্ট্রকে বৈধতা দেয় না। বরং, বৈধতাপ্রসাদের জন্য জনতাই রাষ্ট্রের দুয়ারে লম্বা লাইন দেয়। দেশ সহজ ভালবাসার বিষয় থাকে না। তাকে ভক্তিভরে পরিধান করে দলবদ্ধ কুচকাওয়াজে যেতে হয়।
অন্য দিকে, এনআরসি-র ব্যবহারিক উপযোগিতাও যথেষ্ট। প্রথম খসড়া প্রকাশের পর হিন্দু বাঙালি কিছুটা হলেও উদ্বিগ্ন। শিলচর শহরে নাগরিক সভা, সাংবাদিক সম্মেলন হয়েছে। এটা বিজেপির লোকসানের খাতায়। আর লাভের খাতায় লেখা হবে, ভূমিপুত্রদের আশ্বস্ত করা গেছে। বলতে পারা যাচ্ছে, বাংলাদেশি তাড়ানোর জন্য কত কাজ করছি, দেখো। নোট বাতিলের সময়েও যেমন সফল প্রচার করা গিয়েছিল যে কালোবাজারিদের শায়েস্তা করছি, আপনারাও ব্যাংকে লাইন দিয়ে দেশ বাঁচান।
হিন্দু ডি-ভোটারদের কী হবে? এর জবাব হয়তো আছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে। কৈলাস বিজয়বর্গীয় আশ্বাস দিয়েছেন, ২০১৯-এর ভোটের আগে বিল পাশ হয়ে যাবে। বিল পাশ হলে হিন্দুরা ছাড়া পেয়ে যাবেন। ছাঁকনাতে আটকে যাবেন মুসলমান ডি-ভোটাররা। বিভাজনের রাজনীতির পক্ষে এর চেয়ে বড় জয় আর কী হতে পারে?
আইআইটি, গুয়াহাটি-তে অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy