রামসীতা: যুদ্ধং দেহি নন, হাসিখুশি রামের রূপায়ণ বাংলার মন্দির টেরাকোটায় বড় কম নেই। প্রতাপেশ্বর মন্দির, কালনা। ছবি: দেবাশিস নন্দী
পশ্চিমবঙ্গের আকাশ এবং বাতাস সরগরম হয়ে উঠেছে। ‘মিলিটারি’ ভক্তি অস্ত্র হাতে কুচকাওয়াজ করছে। রামের নামে মিছিল চলছে, হনুমানের নামে খড়্গ উঠছে, জয়ধ্বনিও। মারমার কাটকাট এই দেখে শুনে একটা প্রশ্ন মনে জেগে উঠছে। ভক্তি ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়, কিন্তু বাঙালির ভক্তি এমন লড়াইখ্যাপা কবে থেকে হল? কবে থেকে এমন যুদ্ধু যুদ্ধু বাই জাগল? বাঙালির ভক্তির রং তো গৈরিকও নয়, লালও নয়। সে লড়াই করে না, ভক্তিতে অপরকে কোল দেয় বলেই তো জানতাম। নবদ্বীপে চৈতন্যদেব এসে লালভক্তিকে অনেক দিনই সাদা করে দিয়ে গিয়েছিলেন।
খেয়াল করা দরকার, চৈতন্যদেব কিন্তু বিশেষ সর্বভারতীয় ভক্তিধারারই অংশ। কবীরের রাম যেমন যুদ্ধবাজ নন, চৈতন্যদেবের কৃষ্ণও তেমনই সুদর্শনচক্রপরায়ণ নন। অপরের গলা কাটার সাধ তাঁদের রাম বা কৃষ্ণের কোনও কালেই ছিল না। কবীরবচনে ‘অন্তরের শাণিত খড়্গ’কেই বিনত করতে বলা হয়েছে, বাইরের খড়্গের প্রশ্নই ওঠেনি।
এই ভক্তি কৃত্তিবাসী রামায়ণ ঘিরেও ঘুরপাক খেয়েছিল। সে গল্প ভারী মনোরম। লঙ্কায় তখন রামরাবণের যুদ্ধ চলছে। ইন্দ্রজিতের নাগপাশবাণে রামলক্ষ্মণ সাপের কবলে পড়েছেন। যায় যায় দশা। তখন ডাক পড়ল গরুড়ের। কুশদ্বীপে আয়েশ করে গরুড় সবে অজগর খাচ্ছিলেন, জরুরি তলব পেয়ে অজগর উগরে ফেলে সোজা যুদ্ধক্ষেত্রে। গরুড়কে দেখে সাপেরা উধাও। রামলক্ষ্মণ প্রাণে বাঁচলেন। প্রাণ ফিরে পেয়ে রাম গরুড়কে বর দিতে চাইলে ‘গরুড় বলেন বাঞ্ছা আছে এই মনে/ দ্বিভুজ মুরলীধর দেখিব নয়নে।’ লড়াকু যুদ্ধবাজ রামকে দেখে তাঁর মন ভরছে না, ত্রিভঙ্গভঙ্গিম বংশীধারী রূপ চাই। রাম পড়লেন মুশকিলে— যুদ্ধক্ষেত্রে বাঁশি বাজালে চলবে কেন? ‘না বলিহ কৃষ্ণমূর্তি করিতে ধারণ/ সে রূপ দেখিলে কি কহিবে কপিগণ।’ সত্যিই তো, কপিরা মিলিটারি রামকেই চেনে! শেষে রফা হল। গরুড় তাঁর পাখা দিয়ে একটা ঘর বানালেন, ‘ভকতবৎসল রাম তাহার ভিতরে/ দান্ডাইল ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিম রূপ ধরে/ ধনুক ত্যজিয়া বাঁশী ধরিলেন করে।’ ও দিকে দূরে বসে সেই দৃশ্য হনুমানের খুব হিংসে— ‘হনু বলে প্রাণপণে করি প্রভু হিত/ পক্ষীর সঙ্গেতে এত কিসের পিরীত।’ তার পর কিছু ক্ষণ রাম গরুড়ের বেশি প্রিয় না হনুমানের, তা নিয়ে টানাটানি। অস্ত্রের নয়, সেই লড়াই ভক্তির, ভালবাসার! কিন্তু কথাটা হচ্ছে, যুদ্ধক্ষেত্রে এই যে অস্ত্র ফেলে ভক্তের ভগবানকে বাঁশি ধরতে হল, এ তো সাদা-ভক্তির ফল, মারমার কাটকাট ভক্তির বিষয় নয়।
নব্যবঙ্গের রামভক্তি দেখে আর একটা ভাবনা মাথায় আসে। তা হল, এই ভক্তিমানদের কি কোনও কৌতুকবোধ নেই, তাঁরা মোটে আমোদ করতে জানেন না? লঙ্কাকাণ্ডে মারপিট হয় বটে, তবে হনুমান আর তার দলবলের কাণ্ডকারখানায় বিস্তর আমোদও পাওয়া যায়। থেকে থেকেই মনে হয়, যেন যুদ্ধ হচ্ছে না, বেশ যুদ্ধ-যুদ্ধ রঙ্গ হচ্ছে। রাবণ রামের দূত অঙ্গদকে রাজসভায় বসতে দিল না। অঙ্গদও কম নয়। সে বেশ করে লেজের সিংহাসন বানিয়ে বসে পড়ে রাবণকে গালমন্দ করতে লাগল। রাবণও কম যায় না। আবার রাবণ যুদ্ধে এসেছে। নীল অমনি নেউলের রূপ ধারণ করে রাবণের রথে এ দিক ও দিক করছে। রাবণ নাকাল। বুঝতে অসুবিধে হয় না কৃত্তিবাসী পাঁচালির এই সব খোশগল্পে বেশ আমোদ হত, যুদ্ধস্পৃহা জাগত না।
পণ্ডিতরা বলবেন, এই সব খোশগল্প আদি কৃত্তিবাসের নয়, কৃত্তিবাসের নামে অন্যরা চালিয়ে দিয়েছিল। হতেই পারে। কিন্তু তাতে আসল কথাটা পালটায় না, কারণ স্পিরিটটা একই— যুদ্ধং দেহি ভক্তি নয়, হাসিখুশি ভক্তি। সাধে কী সুকুমার রায় অনায়াসে রামায়ণ ভেঙে ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’-এর মতো হা-হা-হাসির নাটক লিখতে পেরেছিলেন। বাঙালির ভক্তির সঙ্গে যুদ্ধ-মারামারির ঝগড়া, হাসি-কৌতুক-ব্যঙ্গের চমৎকার এবং স্বাভাবিক সখ্য। শুধু কি কৃত্তিবাস? সংকীর্ণ ভক্তকে নিয়ে ঠাট্টা করতে ভারতচন্দ্রও ছাড়েননি। ব্যাস বিষ্ণুভক্ত, শিবের বিরোধী। কিছুতেই শিবপুজো করবেন না। শেষে হর আর হরি দু’জনে এক শরীরে হাজির। আর একটা কথাও মনে রাখতে হবে। ভারতচন্দ্র যখন এই হরহরির হাঁসজারু তৈরি করছেন, তখন মুসলমানের পীরের সঙ্গে হিন্দুর নারায়ণ মিলেমিশে যাওয়ার উপক্রম তৈরি হয়ে গেছে।
এই যে মিলমিশের ভক্তি, হাস্যময় ভক্তি, এ যে শুধু প্রাগাধুনিক পর্বের বিষয়, তা কিন্তু নয়। এই হাস্যময় সহজ ভক্তির ধারা বঙ্গদেশের সাধারণের মধ্যে বয়ে গিয়েছিল। এই ভক্তি অন্যকে বাদ দেয় না, অন্যের সঙ্গে লড়াই করে না, নির্বিবাদে অন্যের বিশ্বাসে আঘাত করে না, সহবাস করে। উনিশ শতকে কলকাতা শহরে ইংরেজি পড়া নব্যভদ্রলোকেরা ধর্মকে নীতি, দর্শন ইত্যাদির কোঠায় নতুন করে যাচাই করছিলেন। ধর্মের যুক্তিবাদী আদল তৈরি হচ্ছিল, সেই যুক্তি অন্যের সঙ্গে লড়াইয়ের পথেও যাচ্ছিল। দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ কিন্তু ভক্তির সহজরূপটিকে ভোলেননি। তিনি কালীর পূজক, কিন্তু তাঁর মধ্যে লোকায়ত ভক্তির মিলমিশটি গভীর চেহারা পেয়েছিল। সাধারণ মানুষের ভক্তির শিকড়টিকে বুঝতে ও বোঝাতে পেরেছিলেন বলেই রামকৃষ্ণ এত জনপ্রিয়। শাক্ত-বৈষ্ণবে, হিন্দু-মুসলমানে তিনি ভেদ করেননি। আর সবচেয়ে বড় কথা, গোটা রামকৃষ্ণকথামৃত হাস্যরসে ভরপুর। যেখানে রঙ্গ-হাস্য আছে সেখানে লড়াইখ্যাপারা জেগে উঠতে পারে না।
এই যে ভক্তি ধর্মের সঙ্গে বঙ্গজ জনগণের স্বাভাবিক যোগ, এই যোগ যে ধর্মের আফিম নয় সেটা এক সময় মার্ক্সবাদী সংস্কৃতিকর্মী উৎপল দত্ত খুবই টের পেয়েছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন, বামপন্থীদের সঙ্গে সাধারণ জনগণের সহজ সংযোগ নষ্ট হচ্ছে। কমিউনিস্ট না হলেই যে লোকে ‘সাম্রাজ্যবাদের দালাল’ হয় না, এই সহজ কথাটুকু আমাদের বামেরা না বুঝলে মুশকিল। এ কথা বোঝাতেই উৎপল তৈরি করেছিলেন আড্ডাখোর পণ্ডিত জপেনদাকে। জপেনদা ছেলেছোকরা আগুনখেকো বিপ্লবীদের সঙ্গে রাস্তার চায়ের দোকানে বকবক করেন। বার বার বামপন্থীদের মনে করিয়ে দেন, ‘বাস করিস এমন এক দেশে যেখানে ব্রতপার্বণে মানুষের জন্ম আর পুষ্টি।’ বলেন, ‘আগের সংস্কারক ও বিপ্লবীরা যে অস্ত্রগুলো তোদের দিয়ে গেছেন, সেগুলো কোথায় শান দিয়ে আরও ধারালো করে ব্যবহার করবি, না! তাদের ঠেলে দিয়ে আসছিস শোষকদের হাতে। বিবেকানন্দ, রামমোহনকে সঙ্গে নিতে পারিস না… তোরা সর্বনাশ করছিস। তোরা দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধের শিকড় কেটে দিচ্ছিস...জনতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে বিপ্লবীদের যা হয়, হতে বাধ্য, সেই সর্বনাশ ডেকে এনেছিস।’ রামকৃষ্ণভক্ত নাটককার গিরিশচন্দ্রকে নিয়ে গোটা একটা বই লিখেছিলেন উৎপল দত্ত। উদ্দেশ্য ছিল সহজ-সরল ভক্তি কী ভাবে মিশে আছে জনমানসে তার স্বরূপ ব্যাখ্যা করা।
পশ্চিমবঙ্গে এই যে মিলিটারি ভক্তি, হন্তারক খুনে ভক্তি ঢুকতে চাইছে, তার পথ আটকাতে পারে সহজ সরল হাস্যময় ভক্তি। কৃত্তিবাসের গরুড়ের মতো লড়াইখ্যাপা ভক্তির মুখের ওপর সে গড়ে তুলতে পারে ডানার দুর্জেয় ঘর। সাধারণ সহজ ভক্তমানুষকে বাদ দেয়, দূরে ঠেলে দেয় যে তাত্ত্বিক রাজনীতি, সেই রাজনীতির যুক্তি-বুদ্ধির সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগ তৈরি হল না, আবার তাদের যে সহজ সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ছিল তাও পড়ল ঢাকা। সেই পথেই সিঁদ কাটছে মিলিটারি ভক্তি। রাম আর হনুমানকে নিয়ে ভালবেসে রঙ্গ করে যারা নিশ্চিন্ত ছিল তাদের রামের নামে অস্ত্রপরায়ণ করে তোলার রাজনীতি যখন হানা দেয়, তখন সহজভক্তির ধারাটিকেই স্মরণ করা দরকার।
বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy