Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Cattle Smuggling

চক্রবৎ

দুর্নীতিগ্রস্ত, নিপীড়নকারী, প্রভাবশালীর পদানত, দেশব্যাপী পুলিশের এই ভাবমূর্তি দেখিয়া নাগরিক কেবল ক্লান্ত নহেন— হতাশ্বাস।

শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২১ ০১:২১
Share: Save:

কয়লা পাচার বা গরু পাচার চক্রের সহিত জড়িত থাকিবার অভিযোগ উঠিয়াছে পশ্চিমবঙ্গের একশতেরও অধিক ওসি-র বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির দাবি, তাঁহারা গরু এবং কয়লা পাচার করিতে নিয়মিত সহায়তা করিয়াছেন, বিনিময়ে কালো টাকার ভাগ পাইয়াছেন। কেবল থানার স্তরেই এই দুর্নীতি আবদ্ধ, এমন নহে। তদন্তে প্রকাশ, ওই সকল ওসি গরু-কয়লা পাচারের সহিত সংযুক্ত এলাকার থানাগুলিতে ঘুরাইয়া ফিরাইয়া বদলি হইয়াছেন। তথ্যটি সত্য হইলে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তাদেরও এই তদন্ত হইতে অব্যাহতি পাইবার কথা নহে। তদন্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি না, রাজ্যের শাসক দলকে বিব্রত করিবার উদ্দেশ্যে নির্বাচনের পূর্বে কেন্দ্র তদন্তে গতি আনিল কি না, এই সকল প্রশ্ন নিশ্চয়ই উড়াইয়া দেওয়া যায় না। কিন্তু পাচারে পুলিশের অংশীদারির সাক্ষ্য যদি মিলিয়া থাকে, তবে তাহার গুরুত্বকেও লঘু করিয়া দেখা চলে না। সংবাদে প্রকাশ, কয়লা পাচারে অভিযুক্ত অনুপ মাঝি পুলিশের সহিত অপরাধের সংযোগের বিশদ নথিপত্র তুলিয়া দিয়াছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের হাতে। তাহাতে প্রকাশ যে, পুলিশ কেবল উৎকোচ গ্রহণই করে নাই, কার্যত গরু ও কয়লা পাচারচক্রের অন্যতম ব্যবস্থাপক হিসাবে কাজ করিয়াছে। যে পুলিশকর্মীরা এই ব্যবস্থায় যোগ দিতে অপারগ অথবা অনিচ্ছুক, তাঁহারা এলাকা হইতে অপসারিত হইয়াছেন। অনেকেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন থানায় থাকিয়া পাচারের বিস্তৃত ও জটিল ব্যবস্থাকে পুষ্ট করিয়াছেন।

আশঙ্কা গোটা ব্যবস্থাটিকে লইয়া। এখন হয়তো কতিপয় পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্ত হইবে, শাস্তিও হইতে পারে— কিন্তু ব্যবস্থাটি বদলাইবে কি? না কি ওসি, কর্তা, প্রশাসন সব বদলাইলেও একই বন্দোবস্ত চলিতে থাকিবে? নানা রাজ্যের দৃষ্টান্ত, এবং এই রাজ্যের অতীত অভিজ্ঞতা তেমন নিরাশাজনক সম্ভাবনারই ইঙ্গিত দিতেছে। উৎকোচ পাইতে আগ্রহী পুলিশকর্মী কম নহে, কিন্তু উৎকোচ না লইয়া, স্বাধীন ভাবে কাজ করিতে ইচ্ছুক পুলিশকর্মীও কি নাই? প্রতিবাদী, বিবেকবান অফিসারদের বার বার বদলি হইতে হয়, তাঁহাদের নানা ভাবে হয়রান করা হয়, এমনকি মিথ্যা অভিযোগে সাসপেন্ড কিংবা বরখাস্তও করা হইয়াছে। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতার সহিত সৎ পুলিশ অফিসারের সংঘাত ভারতে জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের একটি পরিচিত কাহিনি। বিশেষত যখনই অপরাধচক্র সুদীর্ঘ ও সুবিস্তৃত, তখনই তাহার সহিত ক্ষমতাসীন দলের সম্পর্ক থাকে। স্বাধীনতার সাত দশক পার করিয়াও ভারতে পুলিশি ব্যবস্থাটি রহিয়া গিয়াছে ঔপনিবেশিক আমলের ন্যায়, যেখানে শাসকপক্ষ নিজস্ব ঠ্যাঙাড়েবাহিনীর ন্যায় পুলিশকে ব্যবহার করিতে পারে। ঊর্ধ্বতন কর্তার নির্দেশ মানিতে সকল পুলিশকর্মী দায়বদ্ধ, ইহা তাঁহাদের পেশাদারি শৃঙ্খলার অন্তর্গত। তাহার সহিত যখন আইনরক্ষার দায়িত্বের সংঘাত বাধিয়া যায়, তখন কর্তব্য নির্ধারণ সহজ নহে। অধিকাংশ কর্মী নিরাপদ ও লাভজনক বিকল্পটিই গ্রহণ করেন। ভারতে আইনের শাসনকে বার বার পশ্চাতে সরিতে হইয়াছে, কায়েম হইয়াছে ‘শাসকের আইন’। প্রসঙ্গত, সারদা ও নারদকাণ্ডেও উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারদের জড়িত থাকিবার অভিযোগ উঠিয়াছে।

পুলিশকে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণমুক্ত করিতে, তাহাকে স্বতন্ত্র ও সবল করিতে বহু কমিটি নানা প্রকার সুপারিশ করিয়াছে। সেগুলি হয় উপেক্ষিত হইয়াছে, অথবা কেবল কাগজে-কলমে গৃহীত হইয়াছে, কাজ হয় নাই। তাহার ফলে এক দিকে যেমন আর্থিক দুর্নীতির অপরাধচক্র লালিত হইতেছে, অপর দিকে তেমনই নাগরিকের মানবাধিকার নির্বিচারে লঙ্ঘিত হইতেছে। দুর্নীতিগ্রস্ত, নিপীড়নকারী, প্রভাবশালীর পদানত, দেশব্যাপী পুলিশের এই ভাবমূর্তি দেখিয়া নাগরিক কেবল ক্লান্ত নহেন— হতাশ্বাস।

অন্য বিষয়গুলি:

Cattle Smuggling
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy