রাতারাতি নতুন হওয়া যায় না। পুরনো বছরের জীর্ণতা বা ক্লান্তির অবসানও ঘটানো যায় না। তবুও বাঙালির নববর্ষের উৎসবে ভাটা পড়ে না। বরং দিনটিকে আলাদা করে উদ্যাপন করার প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই চলতে থাকে। হাল-আমলে ফেসবুক বা হোয়াটস্অ্যাপে ফোটোশপ করা নববর্ষের ছবি ট্যাগ করার সময় বাঙালির কি কখনও মনে হয়— ‘আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে?’
কেন যেন বেশ কিছু দিন ধরেই মনে হচ্ছে, পয়লা বৈশাখের উদ্যাপন যেন লোকদেখানো বাঙালিয়ানা। এই একটি দিনেই যেন বাধ্যতামূলক আপাদমস্তক বাঙালি হয়ে উঠতেই হবে! বর্ষবরণ, রবীন্দ্রনাথ, ধুতি-শাড়ি-পাঞ্জাবি, পান্তা-ইলিশ, বৈশাখি সেল, শপিং মলে লক্ষ্মীপেঁচার মোটিফ, রাস্তায় আলপনা, নববর্ষের ব্যানার পোস্টার— বৈশাখ মানেই যেন বাঙালিয়ানার আড়ম্বর। নিন্দকেরা বলেন, শুভ নববর্ষ নাকি শুরু হয় পয়লা বৈশাখে আর চলে পঁচিশে বৈশাখ অবধি। ছাব্বিশে বৈশাখ থেকে সব ভ্যানিশ! আবার চৌদ্দোশো সাতাশে বাঙালি জাগবে! দিন-আনি দিন-খাই গোছের অতি-সাধারণ এক মানুষ পয়লা বৈশাখ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন—‘আমার তো তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই পয়লা বৈশাখ! আমি তো প্রতি দিনই পান্তা খাই!’
নতুন বছর ভাল কাটুক, শুভ হোক— সকলেই চান। কিন্তু কী ভাবে? শুধু এক দিনের উদ্যাপনের আতিশয্যে? না কি বর্ষব্যাপী আন্তরিক প্রচেষ্টায়, ফেলে আসা সময়ের ভুলভ্রান্তির সংশোধনে? আজকাল সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে মনের আনন্দ প্রকাশের চেয়েও বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে অন্যকে দেখাতে চাওয়া যে, আমি কত আনন্দে আছি! হতাশা কি আমাদের বেশি মাত্রায় উৎসবমুখী করে তুলেছে? যদিও জীবনে কোনও কিছুই একদিনে পাল্টায় না, একটি দিনের আনন্দের উপর নির্ভর করে তো মোটেই নয়। তা হলে যেটা করা যেতে পারে, তা হল, নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
অঙ্গীকার বা প্রতিজ্ঞা, ইংরেজিতে যাকে বলে রেজোলিউশন, সে তো গ্লোবাল বাঙালির কাছে অজানা কোনও ব্যাপার নয়! চার হাজার বছরেরও আগে ব্যাবিলন বা রোমেও এই রীতির প্রচলন ছিল। দেবতা জানুসের কাছে বাসিন্দারা অঙ্গীকারবদ্ধ হতেন যে, বিগত বছরের যাবতীয় ঋণ তাঁরা পরিশোধ করে দেবেন বছরের শুরুতেই। আমাদের দেশেও আকবরের রাজত্বকালে ‘ফসলি সন’ তৈরির সময় থেকে নিয়ম করা হয়েছিল, চৈত্রের শেষ দিনের মধ্যে সমস্ত ঋণ-দেনা শোধ করে দিতে হবে, যাতে বছরের প্রথম দিনটি হয় ভারমুক্ত। ধীরে ধীরে প্রথম দিনের এই উৎসব পরিণত হল সামাজিক অনুষ্ঠানে। পূর্ব বাংলায় এই সাংস্কৃতিক উৎসবের মূলে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণা। নববর্ষ হয়ে উঠেছিল স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষার অভিজ্ঞান। আর পরে তার সঙ্গে যুক্ত হয় সৃজনশীলতা।
তা হলে তো এই দিনটি হয়ে উঠতেই পারে বাঙালি চেতনায় নিজেদের নবায়ন ঘটানোর দিন! এই পয়লা বৈশাখ থেকেই তা হলে শুরু করা যাক শাড়ি-জামা-কাপড়ের সঙ্গে বাংলা বই কেনা, বছর ধরে সেই সব বই পড়া এবং নিয়মিত ভাবে বাংলা ভাষার চর্চা শুরু করা। যাতে পয়লা বৈশাখের পর দোসরা বৈশাখই আসতে পারে, সিক্সটিন্থ এপ্রিল নয়! ঐতিহ্যের ধারায় স্বকীয় সাংস্কৃতিক বিশিষ্টতায় আধুনিক পৃথিবীতে নিজেদের বিনির্মাণে শপথ নেওয়ার দিন হোক এই পয়লা বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথই
তো শিখিয়েছিলেন— ‘বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও / ক্ষমা করো আজিকার মতো / পুরাতন বর্ষের সাথে / পুরাতন অপরাধ যত / আজি বাঁধিতেছি বসি সংকল্প নূতন /অন্তরে আমার’!
সময়ের শেষ বা শুরু বলে হয়তো কিছু হয় না। বারো মাসের বছরের শেষ মাস চৈত্রেও বছরের শেষ হয়তো-বা হয় না। চৈত্রের সংক্রান্তি যুক্ত হয় আগামী বছরের সঙ্গে। সংক্রান্তি মানে এক ক্রান্তি থেকে, এক কিনারা থেকে আর এক কিনারায় যাওয়া। আরও নানা গ্রহ-উপগ্রহের সঙ্গে সূর্যের সাঁতরে চলা। সূর্য সাঁতরে চলে, ঋতুরা ফিরে ফিরে আসে। বয়ে চলে প্রাণের অনন্ত প্রবহমানতা। তবে শপথ নেওয়া যাক, যেন পথের পাশের আর একটি গাছকেও তথাকথিত মানবসভ্যতার মূল্য না চোকাতে হয়, শহরের বুক চিরে যাওয়া নদীটির যেন অকালমৃত্যু না ঘটে, জঙ্গল-পাহাড় কেটে ক্ষয় করা পরিসরে যেন বসতি গড়ে তোলা না হয়, একটি শিশুও যেন অভুক্ত না থাকে, রুগ্ণ-জীর্ণ চা-বাগানগুলো যেন বেঁচেবর্তে ওঠে, দূষণমুক্ত পরিবেশে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে যেন মানুষ! যদি আমার চার পাশের প্রাণ ঠিক থাকে, তবেই নতুন বছরে প্রবেশ শুভ। সূর্য মহাবিষুবে পড়লে চৈত্র সংক্রান্তি আবারও ফিরে আসবে। যে প্রাণ প্রকৃতিকে মানুষের থেকে আলাদা করে না, সেই প্রাণ ফিরিয়ে আনাই হোক এই নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা। বাকি বছর জূড়ে শুধু কথায় নয়, কাজের মধ্য দিয়ে নবজন্ম আর ঋণমুক্তি ঘটুক বাঙালির।
(লেখক শিলিগুড়ি সূর্য সেন কলেজের শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy