Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
Poila Baisakh Special

এই বানিয়ে তোলা বাঙালিয়ানা কি রেখে যাবে তার উচাটন!

শরদিন্দু বা পরশুরামে বদ্রীদাস মাড়োয়াড়ি বা কৃপারাম কচালু হল ‘দি আদার’। তারা থাকে বলেই বাঙালির বাঙালিয়ানা দানা বাঁধে... লিখছেন অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়

বাঙালির গৌরব প্রকাশের জন্য যুক্তির অভাব হয় না।

বাঙালির গৌরব প্রকাশের জন্য যুক্তির অভাব হয় না।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৯ ১৯:৫৮
Share: Save:

বাঙালি হওয়া খুবই সহজ। অন্তত চর্যাপদ-মতে তো বটেই। খাপ বুঝে চণ্ডালীকে ঘরনি করে ফেললেই কেল্লা ফতে। ভুসুকুপাদের এই ফর্মুলা যদি মানেন, তা হলে বং কানেকশনের অর্থ একটাই— ঘরজামাই থাকা। রসিকতার সূত্র ধরেই মনে প্রশ্ন জাগে, আজ থেকে কম-বেশি হাজার বছর আগে সিদ্ধাচার্য ভুসুকু কোন গৌরবে নিজেকে ‘বঙ্গালী’ বলে আত্মসুখ অনুভব করেছিলেন? প্রশ্ন জাগে, তিনি কি বাংলারই অন্য কোনও ভুক্তির বাসিন্দা ছিলেন, বঙ্গাল ভুক্তিতে প্রবেশ করেন বিবাহ-সূত্রে? নাকি একেবারেই বাংলার বাইরে থেকে ইনট্রুড করেছিলেন বাংলায়। তার পরে চর্যাপদ-টদ লিখে সেলিব্রিটি? তিব্বতী আকর গ্রন্থ ‘চতুরশীতি-সিদ্ধ-প্রবৃত্তি’, যার বাংলা অনুবাদ করেছিলেন অলকা চট্টোপাধ্যায় ‘চুরাশি সিদ্ধর কাহিনী’ নামে, সেই বইয়ে যে ভুসুকুর কথা রয়েছে, তিনি ‘নলেন্দ্র’ নামে এক রাজ্যের বাসিন্দা। এই নলেন্দ্রই নাকি আজকের নালন্দা। কাজ শেষ। বোঝাই যাচ্ছে, বিহারের লোক ভুসুকু নিজেকে বাঙালি বলতে পেরে বর্তে গিয়েছেন। চণ্ডালীর সঙ্গে আসনাইটা ফাউ।

দুরাত্মার যেমন ছলের অভাব হয় না, বাঙালিরও তেমনই গৌরব প্রকাশের জন্য যুক্তির অভাব হয় না। এই সব যুক্তি বেশির ভাগ সময়েই যাকে বলে ‘কুযুক্তি’। উপরে বর্ণিত ভুসুকুর বাঙালি হওয়া সংক্রান্ত বাখোয়াজিতে এক বার চোখ বোলালেই বোঝা যায়, সেই কুযুক্তির চেহারা কতটা ডেসপারেট হতে পারে। এখান থেকে যদি কেউ প্রশ্ন করেন, বাঙালির গোটাটাই কুযুক্তিতে ভরপুর, তা হলে তা অস্বীকার করা খুবই কঠিন। চর্যাপদের কেসটাই দেখা যাক। বস্তুটা কি আদৌ বাংলা ভাষায় রচিত? ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী না হয়ে যদি রাহুল সাংকৃত্যায়ন চর্যাপদের আবিষ্কর্তা হতেন, তা হলে তা হিন্দির পূর্বসূরি হিসেবে গণ্য হত। এই যদি কাহিনি হয়ে থাকে, তা হলে বাঙালির চরিত্রে গোড়া থেকেই ঘোটালা, এটা মেনে নিলে কাজ অনেক সহজ হয়ে আসে। জটিল সমীকরণ একেবারেই জলভাত হয়ে যায়।

এখান থেকে যদি কেউ ধরে নেন যে, বাঙালির বাঙালিত্বের পুরোটাই বায়বীয়, তা হলেও দুখ্খু করার কিছু নেই। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন সাহেব তো সেই কবেই বলে গিয়েছেন, জাতিসত্তার ব্যাপারটাই ঘোটালা। পুরোটাই ইম্যাজিনেশন। বাঙালির কল্পনাবিলাসের কেন্দ্রে বোধ হয় রয়েছে তার ‘বাঙালিয়ানা’। এটাই বাঙালির সব থেকে বড় ফ্যান্টাসি। এই ফ্যান্টাসির সূত্র ধরেই বাঙালি তার বাঙালিয়ানাকে মাপে। মাপে টাকা-আনা-পাই দিয়ে। ‘ষোলো আনা’ না হলে বাঙালি কীসে! এর মধ্যে খানিক বেনেতি বুদ্ধি আর খানিক আধ্যাত্মিকতাও যে নেই, তা নয়। বাঙালির বাণিজ্যের স্বর্ণযুগের কল্পস্মৃতি আর ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসকে গিরিশ ঘোষের দেওয়া ষোল আনা যেন মিলে মিশে রয়েছে। রয়েছে বৈষ্ণব রসতত্ত্বও। রাধিকা সুন্দরীকে নদী পার করতে কানাই মাঝি তো ষোলো আনাই নিয়েছিল। ফলে বাঙালির জীবনে এই ষোলো আনার হিসেব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কী জ্বালা, এই এক্সপ্রেশন গিয়ে ঠেকেছে একটা রেস্তোরাঁর ব্র্যান্ডিংয়ে। বাঙালির বাঙালিত্বের গোড়ায় কি তবে রয়েছে একান্ত এক ঔদরিকতা? এ সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দুরূহ। কারণ, বাঙালির আর সবই রয়েছে, খালি সমাজ-নৃতত্ত্বে কোনও আগ্রহ নেই। ফলে ভুসুকু থেকে কবীর সুমন পর্যন্ত কাল গড়গড়িয়ে লিনিয়ার, তার প্যাঁচ ও পয়জার নিয়ে বাঙালি মাথা ঘামায় না।


‘বাঙালিয়ানা’-র পাশাপাশি আর একটা টার্ম নিয়ে বঙ্গপুঙ্গবরা এক সময়ে দেদার ভেবেছেন। সেটা ‘সাবেকিয়ানা’।

‘বাঙালিয়ানা’-র পাশাপাশি আর একটা টার্ম নিয়ে বঙ্গপুঙ্গবরা এক সময়ে দেদার ভেবেছেন। সেটা ‘সাবেকিয়ানা’। ১৯৫০ বা ’৬০-এর দশকে এই সাবেকিয়ানার চাপটা খানিক বেশিই ছিল। এর জ্বলন্ত প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে সেই সময়ের বাংলা সিনেমায়। ১৯৫০-এর শেষ দিক থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত বাংলা সিনেমা এমন কিছু এথনিক বিন্দু আর ইথোজ-কে আঁকড়ে ছিল, যা ১৯৮০-পরবর্তী সময়ে আর পাওয়া যায়নি। এই কালপর্বে বাঙালি পুরষের আইকন ধুতি-শার্ট পরা উত্তম কুমার, ধুতি-শার্ট পরা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা সলিল চৌধুরী। বাঙালি মহিলা পাতা কেটে বাঁধা চুল থেকে বি-হাইভ সৌন্দর্যে যাদের অনুসরণ করেছে, তারা সকলেই শাড়ি-সুন্দরী। সুচিত্রাই হোন অথবা সুপ্রিয়া, দূরবিন চোখে মাধবী— কেউই উড়ন তুবড়ি কাটিংয়ের ব্যক্তিত্ব নন। প্রত্যেকের মধ্যেই কেমন একটা মোহ তৈরি করা রহস্য রহস্য ভাব। বাঙালি প্রৌঢ় নিজেকে হয় ছবি বিশ্বাস, না হয় জহর গাঙ্গুলির খাপেই ভেবেছে। একটু বোহেমিয়ান হলে বড়জোর পাহাড়ি সান্যাল। মনে করার চেষ্টা করুন, ‘বাঙালিয়ানা’ বলে ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে যে আর্কিটাইপগুলিকে বিজ্ঞপিত করা হয়েছে, তাদের সকলেই এই সব খাপের। এই খাপেই কিন্তু পরে ঢুকে গিয়েছে আবহমান। একটা বিশেষ সময়পর্বকে ‘বাঙালিয়ানা’ নামক এক হাইপার রিয়্যালিটির আধার হিসেবে ভাবা শুরু হয়েছিল। আজও সেই ভাবনা অমলিন।

আরও পড়ুন: গড়ে তুলি বাঙালির ‘জাতীয়’ বা ‘ন্যাশনাল’ ইতিহাস ও সংস্কারের উদ্যোগ

ধুতি-বাংলা শার্ট পরা নায়ক দাঁড়িয়ে রয়েছে নায়িকার ড্রেসিং গাউন পরা বাবার সামনে। কমল মিত্র মার্কা সেই দুঁদে হবু শ্বশুর দাঁত চিপে চিপে অপমান করছেন নায়ককে। লক্ষণীয়, এই দুই যুযুধান পক্ষ কিন্তু মন ও প্রাণে বাঙালি। তাদের ডায়ালেকটিকস স্টেটাস-কেন্দ্রিক। সাহেবিয়ানা বা বাঙালিয়ানার দ্বন্দ্ব কিন্তু সেটা নয়। একই জিনিস দেখা যায় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ও পরশুরামের একাধিক ছোটগল্পে। পরশুরামের কাহিনিতে ব্যারিস্টার কপোত গুহ ও তাঁর স্ত্রী শিঞ্জিনী গুহ যদি ড্রেসিং গাউন সভ্যতার উদাহরণ হয়ে থাকেন, তা হলে স্বয়ং ব্যোমকেশ বক্সী ধুতি-শার্ট পরা সভ্যতার প্রতীক। এরা কেউ কারও বাঙালিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। তোলার কথাও নয়। শরদিন্দু বা পরশুরামে বদ্রীদাস মাড়োয়াড়ি বা কৃপারাম কচালু হল ‘দি আদার’। তারা থাকে বলেই বাঙালির বাঙালিয়ানা দানা বাঁধে। গন্ডেরীরাম বাটপারিয়া যত ধুরন্ধরই হোক না কেন, সে বাঙালির কাছে তুশ্চু। আজ এই অমুক-শেমিং তমুক-শেমিং নিয়ে হট্টগোলের বাজারে এগুলো প্রাদেশিকতার নিখাদ উদাহরণ। কিন্তু আমরা শরদিন্দু বা পরশুরামকে ছাড় দিই, কারণ তাঁদের বাদ দিলে বাঙালির ঝুলি প্রায় বাবাজি ঠনঠন গোপাল হয়ে দাঁড়ায়। এখানে টাইম আর স্পেসের ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে। শরদিন্দু বা পরশুরামের কাল বাংলা সিনেমায় জারিত হয়ে এমন একটা ‘সাবেক’-এর জন্ম দেয়, যা বাঙালিয়ানা নামের ‘অবধারণা’-র সঙ্গে যাকে বলে খাপে খাপ। এই সাবেকের সঙ্গেই লেপটে রয়েছে বাঙালি অথবা এই বাঙালির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জুড়ে রয়েছে সাবেক।

বাঙালির এই অতীতচারণার অভ্যেসটা কি অসুখের পর্যায়ে? না হলে আজ একটা বাঙালি ক্যুইজিন খুলতে গেলে কেন ম্যানিকিওর করা যুবতীকে সন্ধ্যারানির কাটিংয়ে শাড়ি পরিয়ে পরিবেশন করানো হয়? সেই ফুড জয়েন্টের পুরুষ কর্মচারীরা আবার এরও এককাঠি সরেশ। তাঁদের পরনে পরশুরামের ‘ভূশণ্ডীর মাঠে’-বর্ণিত ঘুন্টি দেওয়া মেরজাই। ‘জন্মভূমি’ সিরিয়ালের আগে তা বাঙালির গণস্মৃতির চৌহদ্দিতেও ছিল না। এতে যে ‘অতীত’টি ফুলেফেঁপে ওঠে, তার ঐতিহাসিকতা নির্ণয় করার ঝুঁকি না নেওয়াই ভাল। কারণ, তেমন কোনও কালকে বাঙালির ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।


ঠিক কত দিন আর সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক করে কাটানো যায়?

সে যাক। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন তো এমনই ‘নেই কাল’-এর কথাও বলেছিলেন। জাতিসত্তা তৈরি করতে গেলে সেটা নাকি অনিবার্য। বাঙালির সেই কালচিহ্নহীন ‘বাঙালিয়ানা’ খানিক তলিয়ে দেখলে শরদিন্দুর ভাষায় ‘ধোকার টাটি’। বস্তুটা আদপে নেই, কিন্তু আছে বলে বার বার ভ্রম হয়। ওপার বাংলায় বাঙালিয়ানার ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা। ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধ তাকে একটা ঘনবদ্ধ রূপ দিয়েছে। সেই বাঙালিয়ানার সঙ্গে এপারের বাঙালিয়ানার প্রায় কোনও মিলই নেই। যেমন নেই অনাবাসী বাঙালিত্বের সঙ্গে। প্রবাসে দৈবের বশে এপার, ওপার মিলিজুলি যে বাঙালিয়ানা গড়ে দিয়েছে, তা কলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালিয়ানা থেকে বহু দূরে। এটাও মনে রাখা দরকার যে, ওপার আর অপার (অনাবাসী)-এর বাঙালিয়ানায় আর যাই থাক ‘সাবেক’ নেই। সেই বাঙালিয়ানায় অন্য ঘাপলা থাকতে পারে, কিন্তু অতীতমুখীনতা একেবারেই নেই।

তা হলে কলকাতার বাঙালিয়ানা, যা একতরফা ভাবে এই বাংলার অন্যত্রও অনুসৃত, একটা গভীর শূন্যগর্ভ কেত্তন? যদি নেই-আঁকড়ার মতো কিছু ক্লিশে প্রশ্ন তোলা যায়, কলকাতার বাঙালিকে যদি তার গত তিরিশ বছরের নিজস্ব অ্যাচিভমেন্টের খতিয়ান নিতে বলা হয়, সে মুহ-তোড় জবাব দিতে প্রস্তুত তো? ঠিক কত দিন আর সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক করে কাটানো যায়? কত দিন যায় তিন বাঁড়ুজ্যের পাদোদকে স্নান করে? গত তিরিশ বছরে উঠে আসা বাঙালি চিত্রকর বা ভাস্কর ঠিক কারা? ‘উঠে আসা’ অবশ্যই মিডিয়াধন্য হওয়া নয়। ক’জন বাঙালি লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা গণ-আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেকে স্থিত করতে পেরেছেন? মিডিয়াকে গালাগাল দিয়ে লাভ নেই। মিডিয়া এখন বেচারা। তার জায়গায় জ্বলজ্বল করছে সোশ্যাল মিডিয়া। সেই মহাশক্তিশালী গণমাধ্যমে, গত দশ বছর ধরে এপার-বাঙালি আত্মপ্রক্ষেপণ ছাড়া আর কী করেছে?

আরও পড়ুন: ইতিহাসের হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর ১৯১১

অপ্রিয় প্রসঙ্গ থাক। তবে এটা বলা অসঙ্গত হবে না যে, ১৯৫০ থেকে মিলেনিয়াম-উত্তীর্ণ কালপর্বে বাঙালি তার বাঙালিয়ানার ব্র্যান্ডিংয়ে যতটা শ্রম দিয়েছে, তার গুণমান উন্নয়নে ততটা দেয়নি। গত বছর পাঁচেকে ‘বাঙালি থিমের’ বিয়েবাড়ির বাড়বাড়ন্ত এই ব্র্যান্ডিংয়ের একটা ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। মেরজাই পরা ক্যাটারার সুচারু করে কাটা কলাপাতায় বোঁটা সমেত বেগুনভাজা, লুচি-পাঁঠা তুলে দিচ্ছেন, চার পাশে সাদাসিধে শাড়িতে জিম-ট্রিম মেয়েরা শোভা বাড়াচ্ছেন, ডিজিটাল নয়, রক্তমাংসের নহবত বাজছে— এমন বিয়েবাড়ি এখন আকছার। এটা দেখলে কেমন একটা বিপন্ন লাগে। বাঙালির দুর্গাপুজোয় যেখানে ছলকে উঠছে উত্তর ভারতীয় নবরাত্রি, কালীপুজো তো কবেই দেওয়ালির আলোকগর্ভে লীন, বাঙালির সন্ধে রাতগুলো খেয়ে নিয়েছে সাস-বহু কনফ্লিক্টের হিন্দি দাস্তান, সেখানে একমাত্র বিয়েবাড়ি আঁকড়ে সে আর কত দূর যাবে? এই ব্র্যান্ডিং কি তাকে, তার ‘বাঙালিয়ানা’-কে বাঁচাতে পারবে? নাকি, এটাই এপার বাংলার বাঙালির বাঙালিয়ানার সোয়ান সং? এর পরেই সকলি ফুরাবে স্বপনপ্রায়?

এই লেখা পড়তে বসে একে প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট বলে মনে হতে পারে। হোক গিয়ে। কথাটা যখন বাঙালিয়ানা নিয়ে, তখন তাকে আলাদা করে চিনতে গেলে একটা ‘অপর’ লাগবেই। পরশুরাম বা শরদিন্দুর মতো মানুষও সেই অর্থে এই দোষে দুষ্ট ছিলেন। কিন্তু একটা কোথাও বাঙালি নামক জীবটিকে তাঁরা একটা এথনিক বিন্দুতে বাঁধতে পেরেছিলেন। সেটা ধুতি-শার্ট বা মেরজাই-বালাপোশের বহিরঙ্গে নয়। বাঙালির ক্ষুদ্রতা, স্বার্থপরতা, হীনতা, দারিদ্র, আবেগ, প্রেম, ঈর্ষা, সহমর্মিতা, ঔদার্য— সব কিছু মিলিয়ে একটা আইডিয়া এই দুই মহাপুরুষ পেরেছিলেন গড়ে তুলতে। বোমকেশ বক্সীর অমলিন জনপ্রিয়তার পিছনে কেবল গোয়েন্দা কাহিনির টান নেই। রয়েছে বাঙালিয়ানা নামক এক মরীচিমায়াও। যাকে ধরি ধরি মনে করে এক লহমার জন্য ধরে ফেলাও যায়। এর মধ্যে অতীতবিলাস রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাকে ছাপিয়ে একটা উষ্ণতাও রয়েছে, যার রসায়ন খুব সহজ নয়।


পশ্চিম বাঙালির বাঙালিয়ানার ভবিষ্যৎ কি একেবারেই আদিগঙ্গায়?

বঙ্কিম বা রবীন্দ্রনাথের বাঙালি আজ একেবারেই মিউজিয়াম-শোভন। কিন্তু পরশুরাম বা শরদিন্দুর বাঙালির ছিটেফোঁটা আজও রয়ে গিয়েছে। এর প্রমাণ উত্তম কুমারের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায়। এই লেখায় আগে বলার চেষ্টা করা হয়েছে, পরশুরাম বা শরদিন্দুর লেখা থেকে উঠে আসা আর্কিটাইপ আর ১৯৬০-এর দশকে উত্তম কুমার-সভ্যতার আর্কিটাইপ প্রায় অভিন্ন। কেন এক মিলেনিয়াম-উত্তীর্ণ পরিচালককে ফিরে যেতে হয় উত্তম-অভিনীত ছবিগুলির পুনর্নির্মাণে? সেই সব ছবির বাণিজ্য সাফল্য আজকের প্রজন্ম মনে রাখে না। কিন্তু, তার পরেও কেন পুনর্নির্মিত হয় ‘চৌরঙ্গী’ বা ‘সন্ন্যাসী রাজা’? যদি এটাকে ধরে নিই ‘বাঙালিয়ানা’ নামক ‘এথনিকতা’র পুনর্নির্মাণ, তা হলে কি খুব ভুল করব? উত্তম নন, তাঁর ইমেজ-ধন্য বাঙালিয়ানাকেই খুঁজছে কি এই সব নির্মাণ? খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে কি? আজকের প্রজন্ম কি সেই উষ্ণতাকে ছুঁতে পারছে এই সব নির্মাণ থেকে?

দু’দশক আগে বাংলা গানের জগতে রিমেকের ধামাকাও ছিল এই উষ্ণতার সন্ধানে। একই সঙ্গে দুই প্রজন্মকে ধরতে চেয়েছিল বাংলা মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি। নস্ট্যালজিয়া-তাড়িত সিনিয়র আর কোয়ালিটি গান-সন্ধানী জুনিয়র। কিন্তু সেই ধামাকা খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ডিজিটাল প্রযুক্তি কিছু দিনের মধ্যেই আসলকে হাজির করে নবীকরণ করে। আর ইউটিউবের কল্যাণে তা মুঠোবন্দি হয়ে গেলে কেউ ফিরে তাকায়নি নকল নবিশদের দিকে। সিনেমার রিমেকও সেই দিকে গড়াবে না তো?

আরও পড়ুন: বিবেকানন্দের হিন্দুত্ব না বুঝিয়ে জনগণকে স্বামীজির সরল কথা সরল ভাবেই বোঝানো যেত

তা হলে কী হবে অতি সন্তর্পণে গড়ে তোলা ‘বাঙালিয়ানা’-র প্রকল্পের? সেটা তো বানচাল হবেই। তা হলে পশ্চিম বাঙালির বাঙালিয়ানার ভবিষ্যৎ কি একেবারেই আদিগঙ্গায়? প্রশ্ন সহজ। কিন্তু উত্তর জানা নেই। কোথায় এপার বাংলার বাঙালি ঘটি-বাঙাল-ক্রিকেট-ফুটবল-বামুন-কায়েত-নমঃশূদ্র-মুড়ি-বাতাসা-শাক্ত-বৈষ্ণব-চপশিল্প ইত্যাদিকে উত্তীর্ণ করেও বাঙালি? কোথায়...

কেমন একটা দিশেহারা লাগে। মিলেনিয়াল প্রজন্ম পাড়ি দিচ্ছে দেশান্তর। অনিবার্য ছিল এই দলবদ্ধ প্রবাস। কিন্তু সেই প্রবাসে কি তার জীবতারা আর দেহ-আকাশ বাঙালিয়ানার সন্ধান করবে? যা ‘নেই’ তাকে আঁকড়াতে চেয়ে তর্ক করবে, ঝগড়া করবে, দরকার হল মারামারি করবে? ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন প্রজন্ম কি বিনিসুতোর সেই হাইপার রিয়্যালিটিকে আদৌ প্রশ্রয় দেবে? না দিলেও তো ক্ষতি নেই! শূন্যের মাঝারে ঘর বানিয়ে লাভ কী?

কিন্তু ভোলা কি যায়? সিলিকন ভ্যালির সাদা আলোয় ল্যাপটপের বাটন টিপতে টিপতে যদি কেউ ক্লান্তি অপনোদন করতে গিয়ে ইন্টারনেটেই পড়তে শুরু করে চর্যাপদ। ভুল করেও পড়ে ফেলে— আজি ভুসু বঙ্গালী ভইলী।/ ণিঅ ঘরিণী চণ্ডালী লেলী? যদি এক লবণাম্বু-শাসিত আভাতিবেলায়, তার মনে পড়ে তার স্মৃতির চাইতে অনেক দূরে নিশ্চিন্দিপুরের এক গাছতলায় আস্তে আস্তে মারা যাচ্ছেন এক সহায়-সম্বলহীনা বৃদ্ধা, আর তাঁর মৃত্যু এসে মুছে দিচ্ছে কাল-অতিকালের সীমারেখা? যদি একবার সে হারিয়ে যায় ফিয়র্স লেন ছেড়ে হঠকারিতায়? যদি সে এক বার দেখে ফেলে কী করে হাইড্রান্ট থেকে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল? এক বার যদি ইউটিউবের বাটন দাবিয়ে শুনে ফেলে ‘হারালো হারালো মন হারালো’, তখন কী হবে? কানাডার শীতের ভোরে, বসন্ত পূর্ণিমার রাতে বেঙ্গালুরুর ফ্ল্যাট বাড়ির ছাদে, হাইড পার্ক অথবা ব্রুকলিন ব্রিজের ব্যস্ততাতেও যদি মাথার মধ্যে বেজে ওঠে ‘মন খারাপ করা বিকেল মানে মেঘ করেছে’? তখন তার চাপ কে নেবে? ঘনিয়ে তোলা, বানিয়ে তোলা ‘বাঙালিয়ানা’ দিয়ে কি আদৌ রোখা যাবে তার সেই উচাটন? কোনও স্তোক দিয়ে কি থমকিয়ে রাখা যাবে তাকে? শিকড়ের সন্ধান শুরু হয় শূন্যতার বোধ থেকেই। তেমন এক বোধ থেকেই বব মার্লে শুরু করেছিলেন তাঁর আফ্রো-যাত্রা। শুরু হয়েছিল রাস্তাফারি আন্দোলন। তেমন যদি কিছু ঘটে যায় কখনও?

নাঃ। স্বপ্ন দেখাটা ছাড়তে পারছি না কিছুতেই!

(লেখক প্রাবন্ধিক ও কবি)

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE