হরেকৃষ্ণ সাহা।
ক্লাসে প্রত্যেক বিষয়ে তিনি হতেন প্রথম, যদিও বা কখনও কোনও বিষয়ে দু-এক নম্বরের জন্য সেকেন্ড হতেন, তা হলে দুঃখে ও ক্ষোভে কয়েক দিন পর্যন্ত চলত অনশন। কিন্তু অন্তরের ইচ্ছা ছিল বড় শিল্পী হওয়া, চিত্রশিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। গ্রামের অনতিদূরে খোলা মাঠে ক্রীড়ারত বন্ধুগণের আবেষ্টণীর মধ্যে থেকেও অস্তগামী সূর্যের পার্শ্বচর আলোমাখা মেঘগুলির সৌন্দর্য সৌরভে এতটাই মুগ্ধ হয়ে যেতেন যে বাড়িমুখী হওয়ার কথা বন্ধুদের স্মরণ করাতে হত। তাঁর এমন গভীর শিল্পানুরাগের অভিব্যক্তি পরিলক্ষিত হয় অতি শৈশবেই।
১৮৮৩ সালের ২৩শে জানুয়ারি বিরল প্রতিভার অধিকারী চিত্রশিল্পী হরেকৃষ্ণ সাহার জন্ম হয় চারুশিল্প বৈভবে অখ্যাত মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায়। পিতা বনোয়ারি সাহার কনিষ্ঠ সন্তান পাঠশালার প্রাথমিক ও পরবর্তী স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা অতিক্রম করে কৃতিত্বের সঙ্গে ১৭ বছর বয়সে বেলডাঙা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। সে সময় উক্ত পরীক্ষায় ছবি আঁকা ছিল অপশনাল, বা ইচ্ছে হলে দেওয়া যেত, বাধ্যবাধকতা ছিল না। কিন্তু তবুও তিনি তাতে পাশ করে স্টার মার্ক পান। অথচ, তার আগে অবশ্য তিনি কখনও কোনও শিক্ষকের কাছে তালিম নেননি। সংসারের অবস্থা ছিল নুন আনতে পান্তা ফুরোয় গোছের।
তবুও অতি কষ্টে দেড় বছর এফএ পড়ার পর শিল্পশিক্ষার জন্য দৃঢ় সংকল্প হন। তখনকার দিনে এই প্রকার শিল্পশিক্ষার প্রতি সাধারণ মানুষের নির্ভরতা কিছুই ছিল না, ছিল কেবল নিরুৎসাহের বাণী। কিন্তু তিনি একান্ত অনুরাগ বশত ওই সকল বিরুদ্ধবাদীদের কথায় কর্ণপাত না করে ধ্রুব বিশ্বাসের বশে ক্রমাগত চেষ্টার দ্বারা নিজের সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেই শিল্পশিক্ষা গ্রহণের জন্য সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং ৬ বছর শিক্ষা গ্রহণের পরে বিশেষ যশের সঙ্গে সকল বিষয়ে উত্তীর্ণ হন। এ ছাড়া তিনি আর্ট কলেজের স্বনামধন্য অধ্যক্ষ বি হ্যাভেল এবং সহকারী অধ্যক্ষের দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত হন। শুধু তাই নয়, সহকারী অধ্যক্ষ তাঁর সম্পর্কে শংসাপত্রে লিখেছিলেন হরেকৃষ্ণ খুবই প্রতিভাধর। চিত্রশিল্প শিক্ষার্থে হরেকৃষ্ণকে ইউরোপে পাঠানো উচিত বলেও তিনি মনে করতেন। এমন প্রশংসা সকলের ভাগ্যে জুটত না।
আর্ট কলেজে পড়ার সময় একান্ত আর্থিক অনটনের জন্য লালগোলার মহারাজা বাহাদুর যোগীন্দ্রনারায়ণ রায়, কাশিমবাজারের রাজা আশুতোষনাথ রায় বাহাদুর এবং মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর কাছ থেকে বিশেষ ভাবে আর্থিক সহায়তা পান। শুধু তাই নয়, মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র প্রায় ৪ বছর হরেকৃষ্ণকে তাঁঁর কলকাতার বাগানবাটীতে (বর্তমানে ৩০২ নম্বর আপার সার্কুলার রোড) আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন। ওই সময় অর্থাৎ ১৯০৬ সালের কিছু পূর্বে, তখনও বহরমপুর অবধি রেললাইন হয়নি, তিনি বেলডাঙার বাড়ি থেকে গোরুর গাড়ি করে ৯৪ মাইল দূরে পলাশির রণক্ষেত্রে উপস্থিত হন এবং ক্ষেত্র সমীক্ষায় প্রস্তুত করেন রণক্ষেত্রের তৎকালীন স্কেচ। অনতিকাল পরে ১৯০৬ সালে প্রিন্স অব ওয়েলস কলকাতায় এলে হরেকৃষ্ণ সাহা ওই পেন্টিংটি তাঁকে উপহার হিসাবে প্রদান করলে প্রিন্স অব ওয়েলস প্রীত হয়েছিলেন।
তখন বড়লাট লর্ড মিন্টো অবশ্য ওই পেন্টিংটি অন্য কারও ছবি দেখে আঁকা বলে ভেবেছিলেন। উত্তরে তিনি যখন জানলেন যে, এটা অন্য কারও ছবি দেখে আঁকা নয়, বরং স্থানীয় এক ছাত্র এঁকেছেন, মিন্টো খুবই অবাক হয়েছিলেন। তার পরে এই তরুণ শিল্পী পাইকপাড়ার রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র সিংহ, ঝিন্দের রাজা প্রেরিত জনৈক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীর শিল্পশিক্ষক হন। পরে স্বাধীন ভাবে এই শিল্পকর্মের দ্বারা প্রশংসিত হন। তার মধ্যে যেমন ছিলেন অভিজাত ইংরেজ শিল্পানুরাগীরা তেমন ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিচারক সারদাচরণ মিত্র, মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, বিশিষ্ট শিল্পাচার্য জেপি গঙ্গোপাধ্যায়, কৃষ্ণনগরের মহারাজা বাহাদুর, ঢাকার ভাগ্যকুলের রাজা শ্রীনাথ রায়, পাইকপাড়ার রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র সিংহ। অন্য রাজ্যের শিল্পানুরাগীরাও তাঁর ছবির প্রশংসা করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ও হরেকৃষ্ণর আঁকা ছবির শিল্পগুণের ভূয়সী প্রশংসা করতেন। ১৯১৪ সালের ২১শে জুন লিখিত প্রশংসাপত্রে তিনি বলেন—‘‘I have known Babu Hare Krisna Saha for some years and have been some of his paintings. He is a painter of repute and his work has been pronounced excellent by competent judges. I may mention in particular his paintings of the Plassey monument, which struck me as a particularly good specimen of landscape paintings.’’
হরেকৃষ্ণবাবুর অঙ্কিত চিত্র সারা ভারত চিত্র প্রদর্শনীতে সুবর্ণপদক লাভ করে। এ ছাড়াও ১৪টি পৃথক পৃথক শিল্প প্রদর্শনী থেকে ১৪টি সুবর্ণপদক অর্জন করেন। হিন্দুশাস্ত্রোক্ত ধ্যানের সঙ্গে যথাসম্ভব মিলিয়ে দেবদেবীর বহু চিত্রাঙ্কনের জন্য নবদ্বীপ বঙ্গবিবুধজননী সভা থেকে তাঁকে ‘শিল্পাচার্য’ উপাধি ও একটি সুবর্ণপদক দেওয়া হয়। তাঁর অঙ্কিত বহু চিত্র মাসিক বসুমতী, ভারতবর্ষ, মানসী ও মর্মবাণী, আর্যাবর্ত, ভারতী, পুষ্পপাত্র, উপাসনা, গৌরাঙ্গসেবক (পটনা), নওচেতন (কাঠিয়াওয়াড়), সরস্বতী (এলাহাবাদ), ওরিয়েন্ট (ইন্ডিয়ান প্রেস) প্রভৃতি বহু বিখ্যাত পুস্তকে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া সংস্কৃত ভাষা ও সঙ্গীতেও তাঁর বুৎপত্তি ছিল।
শিল্পী হরেকৃষ্ণ সাহা প্রধানত কলকাতাতেই থাকতেন। কলকাতায় তিনি একাধিক আর্ট স্কুল-কলেজের অধ্যাপকও ছিলেন। ৪২ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রিটে ‘দি এম্পায়ার স্টুডিয়ো’ নামে একটি নিজস্ব আর্ট গ্যালারিও তৈরি করেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিরাপত্তার অভাবে বেলডাঙায় চলে আসেন। অবশেষে ১৯৬২ সালে ৮২ বছর বয়সে নিজ বাসগৃহে জেলার গৌরব সূর্য অস্তমিত যান।
এখন তাঁকে পুনরাবিষ্কারের প্রয়োজন। প্রয়োজন তাঁর সব চিত্র সংগ্রহ করে কোনও একটি প্রদর্শনী করা। যাতে তাঁর আঁকা ছবির প্রকৃত কদর হয়। দেশ-বিদেশের মানুষ যাতে বুঝতে পারেন, তিনি কেমন ছবি আঁকতেন। বাংলার শিল্পকলার ইতিহাসে তাঁর স্থান কোথায়, তারও যেন একটি প্রকৃত অনুসন্ধান হয়। সর্বোপরি এখনও জেলার বহু মানুষ জানেনই না, মুর্শিদাবাদেরই সন্তান ছিলেন হরেকৃষ্ণ।
শিক্ষক, কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুল
তথ্যঋণ: ‘শিল্পাচার্য শ্রীহরেকৃষ্ণ সাহা’: মাসিক বসুমতী, ২য় খন্ড, ৪র্থ সংখ্যা-মাঘ ১৩৬৩ বঙ্গাব্দ, ৩৫শ বর্ষ (১৯৫৬ সাল), ‘চিত্রশিল্পী হরেকৃষ্ণ সাহা: বেলডাঙার ইতিকথা’ —হরিনারায়ণ মণ্ডল।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: হরেকৃষ্ণ সাহার পৌত্র গৌতম সাহা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy