হৃদয়ের স্থান কোথায়? বিজ্ঞানী বলিবেন, প্রেম-বিরহ, বেদনা-পুলক, সকলই উদ্ভূত হয় মস্তিষ্কে। তবে কি বক্ষ হৃদয়শূন্য? হৃৎপিণ্ড এক প্রত্যঙ্গমাত্র? অভিজ্ঞতা বিপরীত সাক্ষ্য দেয়। প্রিয়জনের সাক্ষাতে বুকে ঢেউ উঠে, হারাইবার আশঙ্কায় বুক কাঁপিয়া ওঠে, হারাইলে বুক ভাঙিয়া যায়। তাই মানবসভ্যতার সকল সংস্কৃতিতে হৃদয়ের আসন সতত-স্পন্দিত হৃৎপিণ্ডে। তাহার তাম্বুলপত্রের আকারটি প্রেমের আন্তর্জাতিক সংকেত। সম্প্রতি কলিকাতায় যে হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন হইল, তাহার সহিত কি হৃদয়ের যোগ নাই? বুদ্ধি ও তৎপরতার সহিত বহু মানুষের হৃদয়ের সংযোগ না ঘটিলে এক ব্যক্তির হৃৎপিণ্ড অপরের বক্ষে স্থাপিত করার দীর্ঘ, জটিল প্রক্রিয়া সমাধা প্রায় অসম্ভব। একুশ বৎসরে এক অকালমৃত যুবকের পরিবার শোক অতিক্রম করিয়া সন্তানের প্রত্যঙ্গ দানে সম্মতি দিয়াছে। তিনটি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা হাত মিলাইয়া কাজ করিয়াছেন। পুলিশ ও প্রশাসনের অগণিত কর্মী ‘গ্রিন করিডর’ তৈরি করিয়া হৃৎপিণ্ডের দ্রুত পরিবহণ নিশ্চিত করিয়াছেন। প্রতি ধাপে বহু মানুষের সংযোগ ও সহযোগিতা প্রয়োজন হইয়াছে। যে দেশে সামান্য কাজও দুঃসাধ্য হইয়া উঠিতে চাহে, সে দেশে এত দুরূহ কাজ কী করিয়া সম্ভব হইল? আন্দাজ হয়, কর্তব্যের দাবির সহিত হৃদয়ের তাগিদ মিশিয়াছিল।
স্ত্রীপুরুষের প্রেমের যে ধারণার সহিত আমরা পরিচিত, তাহাতে হৃদয়দানের সহিত প্রতিদানেরও সম্পর্ক থাকে। ‘যেখানে তোমার হৃদয়, সেখানে থাকিবে আমারও হৃদয়,’ এই মন্ত্রে দান করিবার ইচ্ছা এবং গ্রহণ করিবার ইচ্ছা, উভয় ধারাই প্রবাহিত। প্রাণিজগতেও ইহার নিদর্শন রহিয়াছে। কিছু কিছু প্রজাতি সঙ্গীকে হারাইলে একাকী অবশিষ্ট জীবন কাটায়, অপর সঙ্গী গ্রহণ করে না। সঙ্গীকে হারাইবার বেদনার আঘাতে কাব্যের সূচনা হইয়াছিল ভারতে, এমনই মনে করা হইয়া থাকে। কিন্তু পাইবার ইচ্ছাকে অতিক্রম করিয়া নিঃশেষ দানের যে ইচ্ছা, তাহা মানবসমাজের বাহিরে মিলিবে কি? মনুষ্যত্ব যাচাই করিবার কষ্টিপাথর যদি থাকে, তাহা নিঃস্বার্থ প্রেম। অপরকে পূর্ণতর জীবনের সন্ধান দিবার মধ্যে মানুষ আপন সার্থকতা খুঁজিয়া পায়। মানবসমাজে স্বার্থের বন্ধনগুলি সহজে ধরা পড়ে। কিন্তু তাহার কতখানি নিঃস্বার্থ দান, তাহা চোখ এড়াইয়া যায়। প্রাথমিক শিক্ষা হইতে উচ্চতম গবেষণা, দাতব্য চিকিৎসালয় হইতে শীর্ষস্তরের মেডিক্যাল কলেজ, বহু সফল প্রতিষ্ঠানের পশ্চাতে আত্মগোপন করিয়া আছে প্রতিদানের আশাহীন দান, যাহা মানবপ্রেমের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
এমন প্রেম মৃত্যুকেও পরাহত করে। একটি প্রাণ নিবিবার পূর্বে অপর একটি প্রাণের দীপ জ্বালাইয়া যায়। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি তার সহায়ক, কিন্তু নির্ণায়ক মানবহৃদয়। আক্ষেপ, হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের বিরলতা নিঃস্বার্থ দানের সীমাও নির্ণয় করিতেছে। চিকিৎসার উৎকর্ষের নিরিখে ভারত পশ্চাৎপদ নহে, কিন্তু দেহদান বা প্রত্যঙ্গদান এখনও সমাজে বিস্তার পায় নাই। শেষকৃত্যের পুরাতন রীতির আকর্ষণ, বৈজ্ঞানিক প্রচারের অভাব, হাসপাতালগুলির অপ্রতুল পরিকাঠামো, এমন নানা কারণে মৃতমস্তিষ্ক ব্যক্তির প্রত্যঙ্গদান, মৃতের দেহদান বিস্তার লাভ করে নাই। কলিকাতায় দিলচাঁদ সিংহের বক্ষে যে হৃৎপিণ্ডটি বসিয়াছে, তাহা বেঙ্গালুরুর এক যুবকের। কলিকাতা কবে হৃদয়দান করিবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy