Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
sushant singh rajput

সাত দিনের ফাঁসি

সুশান্ত সিংহ রাজপুতের জন্য ন্যায়বিচার দাবি করিবার ছলে রিয়া চক্রবর্তীকে বিনা বিচারে সাত দিনের ফাঁসির হুকুম শুনাইয়া দিবার যে দৈনিক কার্যক্রমটি সংবাদমাধ্যমের একাংশ আরম্ভ করিয়াছিল, তাহার জন্য কোনও নিন্দাই যথেষ্ট নহে।

ছবি: পিটিআই

ছবি: পিটিআই

শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

অবশেষে গ্রেফতার হইলেন রিয়া চক্রবর্তী। অভিনেতা সুশান্ত সিংহ রাজপুতকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে নহে; আর্থিক তছরুপের অভিযোগেও নহে— শেষ অবধি তিনি গ্রেফতার হইলেন মাদক জোগান দেওয়ার অভিযোগে। ‘গাঁজা কেস’ বস্তুটি পুলিশমহলে অতি প্রসিদ্ধ বলিয়াই শোনা যায়। কাহাকে হয়রান করিতে হইলে তাহার নামে গাঁজা সরবরাহ করা বা মজুত রাখার মামলা ঠোকাই নাকি দস্তুর। কেহ মুচকি হাসিয়া বলিতেই পারেন, ইহার জন্য সিবিআই-ইডি-এনসিবি! ঘটনাক্রমটি অবশ্য হাসির নহে। টেলিভিশনের সান্ধ্য তরজায় প্রত্যহ যে ভাবে খাপ পঞ্চায়েত বসিতেছিল, যে ভাবে অভিনেত্রীর চরিত্রহনন চলিতেছিল, তাহাকে ভার্চুয়াল গণপিটুনি বলিলে অত্যুক্তি হয় না। রিয়া চক্রবর্তী দোষী কি না, আদালত জানাইবে। অপরাধ করিলে তাঁহাকে বিলক্ষণ শাস্তিও পাইতে হইবে। কিন্তু, সুশান্ত সিংহ রাজপুতের জন্য ন্যায়বিচার দাবি করিবার ছলে রিয়া চক্রবর্তীকে বিনা বিচারে সাত দিনের ফাঁসির হুকুম শুনাইয়া দিবার যে দৈনিক কার্যক্রমটি সংবাদমাধ্যমের একাংশ আরম্ভ করিয়াছিল, তাহার জন্য কোনও নিন্দাই যথেষ্ট নহে।
এক অভিনেতার আত্মহত্যা এমন ভাবে সর্বভারতীয় প্রশ্ন হইয়া উঠিল কেন, বিহারে বিজেপি তাহার উত্তর দিয়াছে। সেখানে বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে সুশান্তের হাসিমুখ পোস্টারে লেখা— ‘না ভুলে হ্যায়, না ভুলনে দেঙ্গে।’ সত্য, ভূমিপুত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে বিহার বনাম মহারাষ্ট্র, মরাঠি বনাম বিহারী বনাম বাঙালি— এমন বিচিত্র সব বিভাজিকায় ভাঙিয়া লইবার পর কি শাসক দল তাহাকে ভুলিতে দিতে পারে! বিশেষত এই মুহূর্তে, যখন দেশের অভ্যন্তরে অর্থনীতি এবং সীমান্তে চিন, এই দুই প্রশ্নের কোনও উত্তর তাহাদের নিকট নাই। অবান্তর প্রসঙ্গে এই অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলিকে ধামাচাপা দিতে পারিলে বিজেপির বিলক্ষণ লাভ। এই রাজনীতি তাহারা পূর্বেও করিয়াছে, ফলে এখন আবার করিলে অবাক হইবার কারণ নাই। বিস্মিত হইতে হয় সংবাদমাধ্যমের একাংশের ভূমিকায়। রেকর্ড পরিমাণ আর্থিক সঙ্কোচন, প্রত্যহ এক লক্ষ নূতন কোভিড সংক্রমণ, বিপুল কর্মসংস্থানহীনতা, ক্রমবর্ধমান আর্থিক অসাম্য— কোনও প্রশ্নই তাহাদের রিয়া-চর্চার খাপ পঞ্চায়েত হইতে সরাইতে পারে নাই। এক বক্তা এই প্রসঙ্গগুলি উত্থাপনের চেষ্টা করিলে উপস্থাপক তাঁহাকে থামাইয়া দিয়া বলেন, এই সব কথা বলিয়া দেশের সময় নষ্ট করা চলিবে না! ইহা কি নেহাতই নির্বুদ্ধিতা? না কি, শাসক দলের স্বার্থরক্ষায় জীবনপণ ঝাঁপ? উত্তরটি জানা। সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ এই ভাবে শাসকের স্বার্থের সহিত সম্পূর্ণ একাত্ম হইয়া উঠিতেছে, এমন উদাহরণ গোটা দুনিয়াতেই বিরল।
পরিসংখ্যান বলিতেছে, যে সকল চ্যানেলে অষ্টপ্রহর রিয়া-পাত যজ্ঞ চলিতেছে, সেগুলির টিআরপি গগনচুম্বী। অর্থাৎ, মানুষ ঝাঁপাইয়া পড়িয়া এই খাপ পঞ্চায়েতের বিচারসভা দেখিতেছে। কেন? তারকা-জীবনের অন্ধকার দিকটির প্রতি আকর্ষণ তো বটেই, পাশাপাশি একটি দাবিও রহিয়াছে— জনগণের বিচারে রিয়া যেহেতু অপরাধী সাব্যস্ত হইয়াছেন, ফলে তাঁহার শাস্তির ব্যবস্থা হইলেই তাহা ন্যায্য বিচার, জনসাধারণের একটি বড় অংশ এই বিশ্বাসে উপনীত। বিজেপি এবং তাহার সহযোগীরা এই আবেগটিকেই সুকৌশলে ব্যবহার করিতেছে। এই গণ-দাবি যে সুচতুর রাজনীতি দ্বারা নির্মিত, মানুষ এই কথাটি বুঝিবে না— এই বিশ্বাসই রাজনীতিকারদের সাহস দিয়াছে। মানুষকেই বুঝিতে হইবে, ন্যায্যতার দাবি যদি করিতেই হয়, সুশান্ত সিংহের পূর্বে সেই দাবিতে অধিকার কাফিল খানের, ভারাভারা রাওয়ের, অকালমৃত পরিযায়ী শ্রমিকদের। এ সব বিস্মৃত হইয়া টিভি চ্যানেল-নির্মিত ‘ন্যায্যতা’ লইয়া মাতিয়া থাকিলে কু-রাজনীতিরই লাভ।

অন্য বিষয়গুলি:

Sushant Singh Rajput Rhea Chakarborty
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE