সংসদে মোদীর একটি বক্তৃতার সময়, তাঁহার বক্তব্য অত্যন্ত হাস্যকর মনে হওয়ায়, কংগ্রেসের রেণুকা চৌধুরি উচ্চৈঃস্বরে হাসিতেছিলেন, সেই অট্টহাস্যের মধ্যে ব্যঙ্গ ও বিরোধিতা ছিল। মোদী সে সম্পর্কে বলিলেন, রামায়ণ সিরিয়ালের পর এমন হাস্য এই আজ শুনিলাম। যদিও মোদী নির্দিষ্ট কোনও চরিত্রের নাম করেন নাই, স্পষ্টতই তাঁহার ইঙ্গিত ছিল রামায়ণের কোনও রাক্ষসীর প্রতি। তাহার পর মোদীর দলেরই এক জন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু, সোশ্যাল মিডিয়ায় এক ভিডিয়ো পোস্ট করেন, যাহাতে প্রথমে রামায়ণ সিরিয়ালের শূর্পনখা চরিত্রটিকে হাসিতে দেখা যাইতেছে, তাহার পর মোদীর বক্তৃতা ও রেণুকার হাস্য। এইখানে রেণুকার সহিত শূর্পনখার তুলনাকে আর কোনও কিছুর আড়ালে লুক্কায়িত রাখা হইল না। প্রতিবাদের মুখে পড়িয়া রিজিজু দ্রুত ভিডিয়োটি সরাইয়া লইলেও, মনোভঙ্গিটিকে সরাইতে পারেন নাই। বিজেপি নারীবিরোধী দল কি না, নারীদের গৃহদাসী ব্যতীত অন্য কোনও ভূমিকায় দেখিতে এই দলের সদস্যদের অসুবিধা ঘটে কি না, বহু প্রশ্নই উঠিতেছে। কিন্তু যে প্রশ্ন সর্বাগ্রে উঠিবে, তাহা বুনিয়াদি ভদ্রতার প্রশ্ন। ভারতের সংসদ বহু কালই অভদ্রতার মুক্তক্ষেত্র। এই স্থানে অসংখ্য চেয়ার টেবিল ভাঙিয়াছে, বহু গালি নিক্ষিপ্ত হইয়াছে, এমনকী মরিচ-স্প্রে কাজে লাগানো হইয়াছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হইয়া এক মাননীয়া সদস্যকে রুচিহীন বিদ্রুপ করিলে, বুঝা যায়, সর্বোচ্চ আসনের সহিত সংলগ্ন যে মর্যাদাবোধ, তাহাও অদৃশ্য হইতে বসিয়াছে। অভদ্র মানুষ অন্যকে হীন প্রতিপন্ন করিতে গিয়া নিজেকে নীচ প্রতিপন্ন করেন। দেশের ভার যাঁহার হস্তে, তিনি অনায়াসে অসংযত ও অপমানজনক মন্তব্য শুরু করিলে, কেবল নিজেকে হীন করেন না, দেশকেই যেন দীনতায় নিমজ্জিত করেন।
ইহা এই মুহূর্তে ভারতীয় সমাজেরই একটি লক্ষণ, অনেকেই আত্মসংবরণকে আর ব্যবহারের আবশ্যিক শর্ত বলিয়া ধরিতেছেন না। রাগিবার, মারিবার, আইন স্বহস্তে লইবার প্রবণতা বাড়িতেছে। এবং প্রতি সপ্তাহে দেশের কোনও না কোনও অতি প্রতিপত্তিশালী নেতা, সাম্প্রদায়িক বা লিঙ্গবৈষম্যময় বা অন্য প্রকার অনৈতিক মন্তব্য করিয়া বসিতেছেন। যেন অসভ্যতার একটি স্বীকৃতি এই দেশে প্রতিষ্ঠিত হইতেছে। শাসক দলের সহিত সম্পৃক্ত মানুষ কখনও বিবর্তনবাদকেই উড়াইয়া দিতেছেন, কখনও বলিতেছেন নারীরা বিয়ার খাইলে প্রভূত গন্ডগোল, কখনও তাজমহলকে হিন্দু মন্দিরে পরিণত করিতে ব্যস্ত হইতেছেন। সকল ক্ষেত্রেই দলের প্রধান নেতারা নীরব, অর্থাৎ অশিক্ষিত অবৈজ্ঞানিক পশ্চাৎমুখী কদর্য মনোভাবের প্রতি সস্নেহ প্রশ্রয় রহিয়াছে। এই দুইটি হয়তো নিঃসম্পর্কিত নহে। শাসক নেতানেত্রীরা তাঁহাদের আচরণের দ্বারা দেশের কাঙ্ক্ষিত প্রবণতার একটি সূচক স্থাপন করেন। তাঁহারা যদি পাড়ার ক্লাবের মস্তানদের ন্যায় মহা আহ্লাদে অভব্যতা উদ্যাপন করেন, তাহা দেখিয়া সাধারণ নাগরিকগণ নিজ লাগাম আলগা করিয়া দিতে উৎসাহ বোধ করিতে পারেন। ভাবিতে পারেন, নারীকে ব্যঙ্গ করিবার মধ্যে, সংখ্যালঘুকে পিটাইবার মধ্যে শ্রেয় আচরণের ফলক গাঁথা। ইঁহাদের দাপট, সংসদে ও গলিপথে, বাড়িতে থাকিলে, এক সময় ইঁহাদের প্রতি অট্টহাস্য হানিবার সাহস না কম পড়ে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy