—ফাইল চিত্র।
অসহিষ্ণুতা লইয়া দেশের উনপঞ্চাশ জন খ্যাতনামা ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর নিকট চিঠি পাঠাইয়াছিলেন। উত্তরে বাষট্টি জন নামজাদা ব্যক্তির পাল্টা চিঠি আসিয়াছে। আরএসএস-এর রক্ত দিয়া লেখা একশত এক জনের চিঠির খবরও ইতিমধ্যে দেশব্যাপী চর্চিত। দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়িয়া চলা ‘অসহিষ্ণুতা’ লইয়া দুশ্চিন্তাকে পাল্টা স্বাক্ষরকারীরা যে ‘সিলেকটিভ আউটবার্স্ট’ বা ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষোভপ্রকাশ হইতে শুরু করিয়া অ্যান্টি-ন্যাশনালিজ়ম বা দেশদ্রোহিতা পর্যন্ত নানা গাল দিয়াছেন, এ সবও সর্বজ্ঞাত। প্রাথমিক ভাবে দ্বিতীয় দলটির কার্যকলাপকে ছেলেমানুষি, সুতরাং উপেক্ষণীয় বলিয়া মনে হইতে পারে। একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের বিপক্ষবাদীদের দল-সমর্থকরা অর্বাচীন তুলোধোনা করিতেছেন, এমন মনে হইতে পারে। তবে, এ সব কিছুর তলায় আছে একটি গভীরতর কথা। সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশের বাহিরের, বিজেপি-অবিজেপির দ্বন্দ্বের বাহিরের আর এক রকম দ্বন্দ্ব। বাস্তবিক, ইহা ভারতীয় সমাজে যাঁহাদের ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ বলা হয়, সেই মানুষগুলি যে বিশেষ ধরনের চিন্তাভাবনা কার্যকলাপ ও জীবনশৈলীর সহিত সংযুক্ত— তাহার সহিত ওই শৈলীবলয়ের বাহিরের সমাজের দ্বন্দ্ব। প্রথম পত্রলেখকরা পড়েন ইন্টেলেকচুয়াল শৈলীবলয়ের মধ্যে। দ্বিতীয় পত্রলেখকরা তাই প্রথম গোষ্ঠীর ভাবনাচিন্তার বিরুদ্ধে শেল-প্রক্ষেপণ করেন। বলিউডের তারকা-চিত্রপরিচালক শেখর কপূরের টুইটে ইতিমধ্যে দ্বন্দ্বটি সামনে আসিয়া পড়িয়াছে। টুইট বলিতেছে, দেশভাগের পর উদ্বাস্তু হইয়া এই দেশে পা রাখা ইস্তক তাঁহার মতো ব্যক্তিকে এখানকার ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ সমাজ দূরে সরাইয়া রাখিয়াছে, ঘৃণা করিয়াছে। তাই তিনি ইন্টেলেকচুয়ালদের সাপের সহিত তুলনা করেন। আর এক চিত্রতারকা কঙ্গনা রানাউতও প্রবল বিদ্বেষসহকারে যে সব কথা বলিয়াছেন, তাহা হইতে ঠিক একই সিদ্ধান্ত টানা সম্ভব।
অর্থাৎ বর্তমানে ভারতীয় সমাজে কেবল হিন্দুত্ববাদ ও তাহার বিরোধীদের সংঘর্ষ চলিতেছে না। একই সঙ্গে ঘটিতেছে, ইন্টেলেকচুয়াল গোত্রের বিরুদ্ধে সাধারণ্যের বিক্ষোভের বিস্ফোরণ। সমাজমাধ্যমের বিবিধ উত্তপ্ত আলাপেও এই একই বিস্ফোরণের ছাপ। বাস্তবিক, এই ক্ষোভবিস্ফোরণকে ভাল করিয়া তলাইয়া না বুঝিলে হয়তো বর্তমান ভারতের নূতন সংখ্যাগুরুবাদের দাপটের চরিত্রও ঠিকমতো বুঝা হয় না। এখানে বিজেপি ও আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদের সহিত আসিয়া মিলিয়া যায় ভারতীয় সমাজের বিশাল সংখ্যক জনতা, যাঁহারা এই ইন্টেলেকচুয়াল সমাজের প্রতি তীব্র বিরুদ্ধ ভাব পোষণকারী। তাঁহাদের পক্ষে যোগদান করেন কিছু নেতৃস্থানীয় মানুষ, যাঁহারা নিজেদের ‘উপযুক্ত মর্যাদা’ না পাইয়া আত্মসঙ্কটে জর্জরিত, ক্ষোভে বিক্ষত। বিরুদ্ধ গুণিজনদের রোষ ফেনায়িত হইয়া উঠে ইন্টেলেকচুয়াল ‘সুবিধাভোগী’দের বিরুদ্ধে। বাংলাতে এই ইন্টেলেকচুয়ালদের বুদ্ধিজীবী বলা হয়, যদিও তাঁহারা সকলেই সঙ্কীর্ণ অর্থে বুদ্ধি দ্বারা জীবিকা অর্জন করেন না।
চিন্তা ও শিল্পজগতের মানুষের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের এই যে ক্ষোভ, তাহাকে কিন্তু ‘এলিট বনাম অবশিষ্ট সমাজ’ বলা কঠিন। কেননা, সমাজতাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক ভাবে ‘এলিট’ ও ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ গোষ্ঠী সমার্থক নহে। সেই দিক দিয়া দেখিলে ইহা এক বিশিষ্ট ধরনের শ্রেণিসংগ্রাম— এক বাঙালি অর্থনীতিবিদ যেমন অনেক দিন আগেই বলিয়াছিলেন, ‘বুদ্ধিজীবী’ একটি সামাজিক শ্রেণির নাম। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘হার্ড ওয়ার্ক বনাম হার্ভার্ড’-এর অবিস্মরণীয় উক্তিটির মধ্যেও ছিল সেই শ্রেণিদ্বন্দ্বেরই ছায়া। অপর্ণা সেনদের বিরুদ্ধে নিন্দাবাক্য যখন বাংলার সমাজমাধ্যমে অপ্রীতিকর চর্চা হইয়া দাঁড়ায়, তাহার পরতে পরতেও খুঁজিয়া পাওয়া যায় সেই শ্রেণিদ্বন্দ্বেরই পরিচিত ঘৃণা ও অপরিচয়। ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি লইয়া কুৎসিত ব্যঙ্গ ও রঙ্গ, কিংবা অমর্ত্য সেনের বিরুদ্ধে ফুঁসিয়া ওঠা বিদ্বেষেও সেই মনোভাবের প্রতিফলন। জনগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদ এই বিশ্ব প্রথম দেখিতেছে না। এবং বুদ্ধি-বোধসম্পন্ন উচ্চশিক্ষিত শিল্পীসাহিত্যিক চিন্তাশীলদের প্রতি ফ্যাসিবাদের আক্রোশও বিগত ও বর্তমান শতকে একটি পরিচিত ইতিহাস। সেই ইন্টেলেকচুয়াল-বিদ্বেষী ফ্যাসিবাদের মঞ্চ হিসাবে ভারতের প্রবল আবির্ভাব— ইহাই কেবল আজিকার নূতন খবর।
যৎকিঞ্চিৎ
যে লোকটা খাবার আনছে, তার ধর্ম তো দেখলাম। কিন্তু যে খাবারটা রেঁধেছে? খাবার যে বাক্সে আনা হল, সেটা যে তৈরি করেছে? যাতে চড়ে খাবার-বাহক এল, সে বাইকই বা কে বানাল? আর, যে ফোন থেকে অ্যাপে এই খাবার চাওয়া হল? ফোনের এত অংশ, অ্যাপের এত কারিকুরি, কোত্থাও বিধর্মী কেউ আঙুল ছোঁয়ায়নি তো? তবে কি স্বপাক খাব? কিন্তু যে বেগুন কড়ায় ছাড়লাম, তা খেত থেকে তুলল কে? ভেবে ব্রেন ফুলে ঢোল। ডাক্তার দেখাব? ওই স্টেথোয় আর কাকে ছুঁয়েছে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy