আমেরিকার মাটিতে জো বাইডেন ও নরেন্দ্র মোদীর দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের অবসরে জানা গেল, ভারতীয় ২৯৭টি পুরাকীর্তি ফিরিয়ে দেবে আমেরিকা। সুসংবাদ সন্দেহ নেই: খ্রিস্টপূর্বাব্দ প্রথম শতকের বাংলার টেরাকোটা যক্ষীমূর্তি, তৃতীয়-চতুর্থ শতকের পূর্ব ভারতের পোড়ামাটির ফুলদানি, পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে তৈরি ব্রোঞ্জের তীর্থঙ্করমূর্তি-সহ পাথর, ধাতু, কাঠ, হাতির দাঁতের তৈরি নানা প্রত্নবস্তু ফিরে আসছে তাদের উৎসস্থল ভারতে। কেবল ঐতিহাসিকতার কারণেই যে এদের গুরুত্ব তা নয়, ভারতীয় সভ্যতার চেতনারও এরা ধারক ও বাহক— ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের এই বিবৃতি নিশ্চয়ই সারগর্ভ। পুরাকীর্তিগুলির আপাতত প্রতীকী হস্তান্তর হয়েছে, অচিরেই পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে।
ঘরের জিনিস ঘরে ফেরানোর অধিকার ও দাবিটি সঙ্গত বটে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে আরও জরুরি ও অপ্রিয় যে প্রশ্নটি করা দরকার তা হল, ঘরের জিনিস বাইরে গেল কী করে? আমেরিকা যে পুরাকীর্তিগুলি ভারতকে ফিরিয়ে দিচ্ছে তার মধ্যে অনেকগুলিই শোভা পাচ্ছিল সুবিখ্যাত মেট্রোপলিটান মিউজ়িয়ম অব আর্ট-এ, অনেকগুলি আমেরিকান সরকারের হাতে ধরা পড়ে ও বাজেয়াপ্ত হয়ে ঠাঁই পেয়েছিল নিউ ইয়র্ক অ্যাটর্নি জেনারেল-এর অফিসে। যে মুহূর্তে তারা বুঝতে পেরেছে যে ভারত থেকে ওই পুরাকীর্তিগুলি চুরি ও পাচার হয়ে অর্থাৎ অসদুপায়ে তাদের দেশে এসেছে, সেগুলি ফিরিয়ে দিতে তারা আর দ্বিধা করেনি। তাদের সাধুবাদ জানাতেই হয়, কিন্তু দেশ থেকে কী ভাবে এই পুরাকীর্তি চুরি ও পাচার হল, কারা এই চক্রে সক্রিয়, এই দুষ্টচক্র নির্মূল করতে ভারত সরকার কতটা তৎপর ও কঠোর— এই প্রশ্নগুলি শুধু বিশেষজ্ঞ মহলেই ঘোরাফেরা করছে বহুদিন। জনপরিসরে তা নিয়ে সচেতনতা দূরস্থান, উচ্চবাচ্যও নেই। অথচ নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সরকার অহরহ যে ভারতগৌরব, বিশেষত প্রাচীন ভারতগৌরব তুলে ধরেন, তার সঙ্গে এই পুরাকীর্তিগুলির লালন ও রক্ষণের নির্বিকল্প প্রশ্নটি জড়িয়ে। বিজেপি সরকার এখন নিশ্চিত ভাবেই প্রাচীন পুরাকীর্তিগুলির দেশে ফেরাকে নরেন্দ্র মোদীর সাফল্য বলে প্রচার করবে, কিন্তু ঘটে যা তা সব সত্য কি?
পুরাকীর্তি দেশে ফেরানোর লক্ষ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক কাজে লাগানো, আমেরিকার সঙ্গে ‘কালচারাল প্রপার্টি এগ্রিমেন্ট’-এর সুবাদে সে দেশের মিউজ়িয়মগুলির সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া, এই পদক্ষেপগুলির গুরুত্ব অস্বীকারের উপায় নেই। কিন্তু এই সবই ‘বাইরের’ কাজ, ‘ঘরে’ যাতে এই অমূল্য প্রত্নবস্তুগুলি সুরক্ষিত থাকে, সেই ক্ষেত্রটি নিশ্ছিদ্র নয়। ভারতে প্রত্নস্থল ও পুরাকীর্তি সংরক্ষণের ভার ন্যস্ত ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (এএসআই)-এর কাঁধে; তাদের হিসাবে হারিয়ে যাওয়া পুরাকীর্তির সংখ্যা যত, বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে তা অনেক বেশি। এএসআই-এর পুরাকীর্তি রক্ষণের ‘সামর্থ্য’ও প্রশ্নাতীত নয়, সিএজি-র রিপোর্টে দেখা গেছে, পুরাকীর্তি-চুরি ঠেকাতে তাদের কোনও ভিজিল্যান্স বা মনিটরিং সেল নেই। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধীনে থাকার বাধ্যতা, স্বশাসনহীনতা, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকাঠামোর অভাব, এই সবই যে তাদের কাজে প্রভাব ফেলছে, বললে ভুল হবে কি? এই প্রশ্নগুলি তোলা দরকার, ভারতীয় পুরাকীর্তির স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আনন্দ তাতে যতই ফিকে হোক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy