বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।
রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে নানা ডালপালায় বিকাশ লাভ করা যে প্রতিষ্ঠানটি তার সমস্ত অঙ্গ-সহ সামগ্রিক ভাবে বিশ্বভারতী রূপে পরিচিত, তা সম্প্রতি ইউনেস্কো-র বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই স্বীকৃতি যদিও বহিরঙ্গে প্রতিষ্ঠানের সাংস্কৃতিক সৌধগুলির জন্য, তবু প্রকৃতপক্ষে এই স্বীকৃতি রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনার। সেই ভাবনাই এখানকার সৌধাবলি ও পরিবেশের মধ্যে নিহিত। বঙ্গবাসীর পক্ষে একটি গৌরবের কারণ ঘটল, ভারতবর্ষের পক্ষেও। তবে এই আনন্দসংবাদে এই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান কর্তৃপক্ষ যদি নিজেদের ব্যক্তিগত ভাবে গরিমামণ্ডিত করেন তা হলে তাঁরা ভুল করছেন, সম্ভবত উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই। এ সংবাদ আনন্দের, দায়িত্বের, কিন্তু ব্যক্তিগত গরিমার নয়, কারণ ইউনেস্কো-র তালিকায় এই প্রতিষ্ঠান বর্তমান আধিকারিকদের গড়ে তোলা ব্যবস্থা ও অবস্থার কারণে প্রবিষ্ট হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত ভাবে যেমন কোনও স্থির অবস্থাকে ঐতিহ্য বলে মনে করতেন না, তেমনই এ কথাও সত্য, কতকগুলি আদর্শকে তিনি এ দেশীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে কেবল নয়, বৈশ্বিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও চিরায়ত বলে মনে করতেন। সেই সত্যগুলির একটি হল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি কেবলমাত্র পুঁজির দাস হবে না। উপযোগবাদী চাকরিমুখী শিক্ষার স্বার্থ-সাধন করাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। শিক্ষালয়গুলির সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সামাজিক যোগ থাকবে। শিক্ষাব্যবস্থায় সঙ্কীর্ণ দৈশিকতার অবরোধ তৈরি করা অনুচিত। বিশ্বের সমস্ত শিক্ষালয়ের মধ্যে আদানপ্রদানের ব্যবস্থা জরুরি। শিক্ষা কেবল মানবগরিমার জন্য প্রদান করা হবে না, প্রাকৃতিক জগতের সঙ্গে শিক্ষালয়ের জীবনযাত্রার ও পরিবেশের সামঞ্জস্য থাকবে। এক কথায় বলা চলে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে, জ্ঞানের সামাজিক বিস্তারের সূত্রে, প্রাকৃতিক পরিবেশের হানি না ঘটিয়ে সমস্ত রকম বিচ্ছিন্নতা ও বিচ্ছিন্নতার বিরোধী আদর্শ গড়ে তোলাই বড় হয়ে উঠেছে। এক দিনে নয়, দীর্ঘ দিনের প্রচেষ্টায় ধাপে ধাপে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবৎকালে এই ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। বিশ্বভারতীর আদর্শ ঘোষণার পর তিনি ব্রহ্মচর্যাশ্রমকে নানা ভাবে বিস্তার দিলেন। পল্লি পুনর্গঠনের কাজ শুরু হল, কলা-বিজ্ঞানের পাশাপাশি নৃত্য-নাট্য-শিল্পের পাঠক্রম তৈরি হল। ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ভাষা পাঠের ব্যবস্থা হল। এই সব কিছু মিলিয়ে যে বিশ্বভারতী, তা-ই আজ বিশ্বের স্বীকৃতি লাভ করেছে।
এই মুহূর্তে আত্মগরিমা ত্যাগ করে বর্তমান কর্তৃপক্ষের উচিত পর্যালোচনায় বসা। এই আদর্শগুলি থেকে যে প্রতিষ্ঠানটি বিচ্যুত তা সাম্প্রতিক ঘটনাবলি প্রমাণ করছে। রবীন্দ্রনাথ যেমন কখনও পরিবর্তনহীনতার পক্ষে ছিলেন না, তেমনই পরিবর্তনের নামে আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ার কথাও তিনি ঘোষণা করেননি। নীতি বা আদর্শের অন্তর্গত সত্যটি নানা পন্থায় অনুসরণ করার জন্যই অচলায়তন-এ গুরু এসে প্রাচীর ভেঙে দেন, আবার সেই ভাঙা প্রাচীরের উপর শোণপাংশুদের নতুন করে পাঁচিল তুলতে বলেন। মূল আদর্শগুলি রূপায়ণের জন্য যে সময় যে পন্থা গ্রহণ করা দরকার, সে সময় সে পন্থা গ্রহণ করতে হবে। পুরনো পন্থা ভেঙে আদর্শ রূপায়ণের জন্য নতুন পন্থা গড়া চাই। এটাই এ নাটকের আদর্শ। অথচ বিশ্বভারতীর আত্মম্ভরি কর্তৃপক্ষ ইচ্ছেমতো আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে নানা রকম সাফাই গাইতে বসেন। মনে রাখতে হবে, এই প্রতিষ্ঠানটিকে বিশেষ ঐতিহ্যের শিরোপা প্রদান করা হয়েছে। ঐতিহ্য হচ্ছে সেই আদর্শ ও মূল্যবোধ যা রক্ষা করা জরুরি। কাজেই বর্তমান কর্তৃপক্ষের কাছে এই মুহূর্তটি দায়িত্ব স্বীকার করার ও সেই দায়িত্ব পালন করার জন্য নিজেদের গড়ে তোলার মাহেন্দ্রক্ষণ। অথচ কর্মকর্তারা সর্বার্থেই ঢাক বাজাতে বসেছেন। ঢাকের দু’টি বোল— প্রথমত, বলা হচ্ছে এই গরিমা তাঁরা বর্তমান প্রশাসকদের কর্মদক্ষতায় লাভ করেছেন। কথাটি ভ্রান্ত। দ্বিতীয়ত, দোষারোপের বাজনা বাজছে। যদি কেউ এ প্রতিষ্ঠানের মঙ্গল চান তা হলে সকলের স্বীকার করার সময় হয়েছে যে আদর্শচ্যুতি ‘তোমার আমার পাপ’। আর একটি কথাও মনে রাখা উচিত। বর্তমান ভারত ধর্ম ও শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছন দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তৎপর। রবীন্দ্রনাথের এই প্রতিষ্ঠান পশ্চাদ্গামী রক্ষণশীলতার বিরোধিতা করেও ভারতীয় ভাবনার মধ্যে যে মূল্যবোধ সার্বিক তাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। ভারতীয় ভাবনার মধ্যে বৈশ্বিকতাকে উদ্ভাবন করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যা মানবহিতকর তাকে সমাদরে গ্রহণ করে রবীন্দ্রনাথ বরেণ্য। হিন্দুত্ববাদী শিক্ষাবিদদের এ কথা উপলব্ধি করা জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy