প্রতীকী চিত্র।
কোনও কাজই ছোট নহে, এই নীতিবাক্য স্মরণে রাখিয়াও বলা প্রয়োজন, যে কাজের জন্য অষ্টম শ্রেণি পাশ হইলেই চলে, স্নাতকোত্তর বা ইঞ্জিনিয়াররাও যদি সেই কাজ করিতে বাধ্য হন, তবে তাহা মানবসম্পদের অক্ষমণীয় অপচয়। যাঁহারা সেই কাজ করিতে বাধ্য হইবেন, ক্ষতি শুধু তাঁহাদেরই নহে— তাঁহাদের শিক্ষার পিছনে রাষ্ট্র যে অর্থ ও শ্রম ব্যয় করিয়াছে, সমাজ যে সহায়তা করিয়াছে, সবেরই সম্পূর্ণ অপচয়। পশ্চিমবঙ্গে হাসপাতালের মর্গে ল্যাবরেটরি অ্যাটেনডেন্ট পদে— আগে যাহার নাম ছিল ডোম— উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের আবেদনপত্র সেই অপচয়েরই মর্মান্তিক বার্তা বহন করে। ডোমের কাজটি কোনও মতেই অপমানজনক নহে। কাজটি অতি গুরুত্বপূর্ণও বটে— এই পদে কেহ কাজ না করিলে হাসপাতাল-মর্গ অচল হইয়া যাইত— কিন্তু ইহাও একই রকম সত্য যে, এই পদে উচ্চশিক্ষার কোনও ব্যবহার নাই। যাঁহারা এই চাকুরির জন্য আবেদন করিতেছেন, তাঁহারা এই সত্যটি জানিয়াই করিতেছেন। স্নাতকোত্তর, এমনকি পিএইচ ডি ডিগ্রিধারীরা অফিস পিয়নের পদে আবেদন করিয়াছেন, এমন ঘটনা তো অশ্রুতপূর্ব নহে। তাঁহারা এই স্বল্পদক্ষতার চাকুরির জন্যও আবেদন করিতে বাধ্য হন একটিই কারণে— তাঁহাদের যোগ্য চাকুরি যথেষ্ট সংখ্যায় নাই।
প্রাক্-বিশ্বায়ন ভারতে যোগ্য চাকুরি জোগাড় করা কতখানি দুরূহ কাজ ছিল, তাহা স্মরণ করিতে হইলে সত্যজিৎ রায়ের জন অরণ্য বা প্রতিদ্বন্দ্বী, অথবা মৃণাল সেনের ইন্টারভিউ দেখিয়া লওয়া যায়। একটি সাধারণ চাকুরির জন্যও জানিতে হইত চাঁদের ওজন কত। গত তিন দশকে পরিস্থিতিটি যে পাল্টাইয়াছিল, তাহার কারণ নিহিত আছে এই অনুচ্ছেদের প্রথম শব্দটিতে— বিশ্বায়ন। ১৯৯১ সালে ভারত সমাজতন্ত্রের ভূতকে পাকাপাকি ভাবে ঝাড়িয়ে ফেলিয়া বিশ্ব-অর্থনীতির সম্মুখে নিজের দরজা-জানলা খুলিয়া দিয়াছিল। সেই খোলা হওয়ায় অর্থব্যবস্থার মরা গাঙে জোয়ার আসিয়াছিল, তাহার সহিত আসিয়াছিল কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা। কেবলমাত্র সরকারি চাকুরির মুখাপেক্ষী থাকিবার বাধ্যবাধকতাকে পিছনে ফেলিয়া ভারতের যুবসমাজ দেখিয়াছিল, হরেক চাকুরির সম্ভাবনা খুলিয়া গিয়াছে তাহাদের সম্মুখে। সেই ঔজ্জ্বল্য ক্ষীয়মাণ হইতেছে কেন? কেন দেশে বেকারত্বের হার অর্ধশতাব্দী কালের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছাইয়াছে? তাহার কারণ কি ইহাই নহে যে, বিশ্বায়ন যে দরজাগুলি খুলিয়াছিল, সাঙাততন্ত্র আসিয়া তাহাতে ফের খিল তুলিয়া দিতেছে?
অর্থনৈতিক সংস্কারের তিন দশক পূর্তি উপলক্ষে সেই সংস্কারের ভগীরথ— ১৯৯১ সালের অর্থমন্ত্রী ও পরবর্তী কালের প্রধানমন্ত্রী— মনমোহন সিংহ সেই বিপদের কথা স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন। তিনি এই অতিমারি-ক্লিষ্ট সময়ের আর্থিক বিপদের কথা বলিবার পাশাপাশি বৃদ্ধির গুরুত্বের কথাও বলিয়াছেন। বস্তুত, ভারত যে কর্মসংস্থানহীনতার বিপদে নিমজ্জিত হইতেছে, অতিমারি তাহাতে বড়জোর অনুঘটকের ভূমিকা পালন করিয়াছে। বিপদটির সূচনা অতিমারির আগেই হইয়াছে। বাজারে চাহিদা না থাকিলে উৎপাদন সঙ্কুচিত হয়, ফলে কর্মসংস্থানও কমে— অর্থশাস্ত্রের একেবারে প্রাথমিক পাঠেই বিপদটির ব্যাখ্যা রহিয়াছে। অর্থশাস্ত্রী ও বিশেষজ্ঞরা বারে বারেই মানুষের হাতে টাকা পৌঁছাইয়া দিবার কথা বলিতেছেন। ঘটনা হইল, যাঁহারা ডোমের চাকুরির জন্য আবেদন করিয়াছেন, সরকারি অর্থসাহায্য বা এনআরইজিএ-র কাজ তাঁহাদের অধিকাংশের জন্যই নহে। কিন্তু, এই পথে মানুষের হাতে টাকা পৌঁছাইলে বাজারে চাহিদাবৃদ্ধির ফলে অর্থব্যবস্থা চাঙ্গা হইলে যে কর্মসংস্থান হইবে, তাহাতে এই কর্মপ্রার্থীদেরও সুরাহা হইবে। অর্থব্যবস্থা এই যুক্তিতেই চলে। দেশের কর্তারা যুক্তিটি বুঝিবেন কি না, তাহাই প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy