Advertisement
১২ জানুয়ারি ২০২৫
Religion of heart

অন্তরের ধর্ম

বিধি-বিরুদ্ধতার এই দ্বিতীয় স্তর নির্মাণ করা হয়েছে কাহিনি বিন্যাসের কৌশল দিয়ে। কাহিনিকার সরাসরি গাছের সমব্যথী শুকপাখির মনেরকথা লিপিবদ্ধ করতে পারতেন।

ছবি : সংগৃহীত।

শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:০৫
Share: Save:

ধর্ম কী, মহাভারত-কাহিনির মহারণ্যে অবিরাম তার সন্ধান করেছেন যুধিষ্ঠির। কোনও নির্দিষ্ট অনুশাসন নিয়ে তিনি ফেরেননি, পেয়েছেন বিচিত্র, বহুবর্ণ সব গল্প। অনুশাসন পর্বে ভীষ্ম তাঁকে একটি পাখির গল্প বলছেন। যে গাছে পাখিটি থাকত, সে গাছে এসে লাগে এক ব্যাধের বিষাক্ত তির। বিষের জ্বালায় গাছটি শুকিয়ে মরতে থাকে, সব পাতা ঝরে যায়, আশ্রিতরা ছেড়ে চলে যায়। কেবল সেই শুক রয়ে যায় গাছের কোটরে। ব্রাহ্মণের বেশে দেবরাজ ইন্দ্র এসে সেই অনাহার-শীর্ণ, মরণাপন্ন পাখিকে প্রশ্ন করেন, বনে এত পাতায়-ফলে ভরা গাছ, এ গাছ ছেড়ে গেলেই তো হয়। শুক উত্তর দেয়, এই গাছ তাকে প্রতিপালন করেছে। অহিংসার পথে থাকতে হলে সে কী করে ভক্তকে ছেড়ে যেতে পারে? বেদনার সমানাভূতি, বা অনুক্রোশই সাধু ব্যক্তিদের মহৎ ধর্মের লক্ষণ, তাকে কেন ত্যাগ করতে বলছেন ব্রাহ্মণ? তা শুনে ইন্দ্র গাছটিকে নবজীবন দান করেন, শুকও দীর্ঘজীবী হয়। যথারীতি, মহাভারতের যে কোনও গল্পের মতো, এই গল্পেও অনেক স্তর। এক অর্থে এ হল মানবধর্মের কথা— অনুক্রোশ, অর্থাৎ অপরের আর্তনাদে আমাদের মুখ থেকে নির্গত আর্তচিৎকার, জীবের স্বাভাবিক প্রবণতা। এমন অনুভূতি কার না হয়েছে? সম্রাট বাবরের মতো, সন্তানের বেদনা নিজের মধ্যে নিতে কে না চেয়েছে?

তা বলে শুক কি আর বিষজর্জর গাছকে বাঁচাতে পারবে? না কি, অন্য প্রাণীরা গাছকে ছেড়ে গিয়ে অন্যায় করেছে? ইন্দ্র-তথা-ব্রাহ্মণ শাস্ত্রের বিধানে শুকের কাজের সমর্থন খুঁজে পাচ্ছেন না। কিন্তু পাখির মতে, অহিংসার পথ বস্তুত বেদনার্তকে ত্যাগ না করার পথ। ঠিক এ ভাবেই যুধিষ্ঠির মহাপ্রস্থানের পথের শেষ প্রান্তে এসে ইন্দ্রকে বলেছিলেন, তিনি অনৃশংসতায় বিশ্বাসী, তাই ভয়ে কম্পমান, অসহায় কুকুরটিকে ছেড়ে স্বর্গেও যেতে চান না। অহিংসা, অনৃশংসতা মানে কেবল অপরকে আঘাত করা নয়, বিপন্নকে ত্যাগ করাও হিংসা। আর ‘ভক্তি’ মানেও আনুগত্য নয়, তা বিশ্বাসের, আস্থার সম্পর্ক। যে সম্পর্ককে মান্যতা দেওয়ার বিধান শাস্ত্রে নেই, এমনকি বিধিপ্রণেতা স্বয়ং যেখানে সমানুভূতির সম্পর্ককে আঁকড়ে থাকার কোনও নৈতিক গুণ দেখতে পাচ্ছেন না (ইন্দ্র যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন যে সাম্রাজ্যের প্রতি, ভাইদের বা স্ত্রীর প্রতি মোহ কাটিয়ে তিনি শেষ অবধি একটা কুকুরের মোহে পড়ে গিয়েছেন), সেখানেও যে ব্যক্তি অনুক্রোশ-নির্দেশিত পথে চলছে, নৈতিক বিচারে তার পথই শ্রেয়। বিধি-বিরুদ্ধতার এই দ্বিতীয় স্তর নির্মাণ করা হয়েছে কাহিনি বিন্যাসের কৌশল দিয়ে। কাহিনিকার সরাসরি গাছের সমব্যথী শুকপাখির মনেরকথা লিপিবদ্ধ করতে পারতেন। তা না করে প্রচলিত নীতি-নিয়মের প্রবক্তার ভূমিকায় ইন্দ্রকে টেনে এনেছেন, প্রতিপক্ষের ভূমিকায়।

কাহিনির তৃতীয় স্তরটি কী, তা মনে ভেসে ওঠে যখন আমরা মনে করি, কে এই কাহিনি কাকে বলেছেন। শুকপাখির কাহিনি ভীষ্ম বলেছেন যুধিষ্ঠিরকে, আর যুধিষ্ঠিরের স্বর্গারোহণের কাহিনি বৈশম্পায়ন শুনিয়েছেন জনমেজয়কে। দু’টি ক্ষেত্রেই এই কাহিনি যাঁর উদ্দেশে বলা হচ্ছে, তিনি শাসক। আর সর্বশেষ স্তরে, এ কাহিনি যে শাসকের উপযুক্ত বার্তা বহন করছে, তা জানছে সর্বসাধারণ। যুগ বদলেছে, তবু ক্ষমতা-মত্তের চেহারা সে দিনও যেমন ছিল, আজও তেমন। শাসক নিজের আইন নিজে মানলেই কৃতার্থ হয় নাগরিক। তবু যা ঘটেছে, যা ঘটছে, তার অর্থ ফুটে ওঠে না, যদি না তাকে রাখা ‘কী হতে পারত’ সেই পশ্চাৎপটে। মহাভারত সেই সম্ভাবনার চালচিত্র নির্মাণ করেছে বিচিত্র ইঙ্গিতবাহী নানা কাহিনি দিয়ে। দৈনন্দিন ঘটনার পিছনে সেখানে আলো-ছায়ার দোলার মতো ঝিলমিল করে নানা সম্ভাবনা। তার একটি হল, বিধি-নিয়ম দিয়ে শাসকের ধর্মের সীমা নির্দিষ্ট হয় না। অহিংসার পথে চলতে হলে সেই সীমাকেও উত্তীর্ণ করে নিজের পথ খুঁজতে হয়। বৃন্দা ডালমিয়ার মতো শুশ্রূষাবাদী দার্শনিকরা আরও এগিয়ে বলেন, দ্যূতসভার যুধিষ্ঠির ধর্মের বিধিতে আবদ্ধ ছিলেন বলেই দ্রৌপদীর লাঞ্ছনায় নীরব থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। কাহিনির শেষে তাঁর উত্তরণ হয়েছে বিধি-অতিক্রান্ত ধর্মের বোধে। যিনি যক্ষের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, যে পথে মহাজন চলেন সেটাই ধর্মের পথ, সেই যুধিষ্ঠির জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ‘মহাজন’-এর প্রতিনিধি, স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রের বিরোধিতা করে তুলে ধরছেন ধর্ম বিষয়ে তাঁর নিজের অনুভব। অনুক্রোশ মানবতার সেই ধর্ম, যা নতমস্তক করেছে দেবতাকেও।

অন্য বিষয়গুলি:

BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy