এক ব্রিটিশ সংস্থার সমীক্ষা জানাইল, অতিমারিকালে কিশোরী ও তরুণীরা সংসারের দৈনন্দিন কাজকর্মের ভার যত সামলাইতেছে, সমবয়সি কিশোর ও তরুণরা তত নহে। ব্রিটেনের চৌদ্দ হইতে চব্বিশ বৎসর বয়স্ক এক হাজার পুরুষ ও নারীকে লইয়া করা সমীক্ষার ফলাফলে প্রকাশ, পরিবারের সকলের জন্য রান্নার কাজে সময় কাটিতেছে ৬৬ শতাংশ কিশোরী ও তরুণীর, একই বয়ঃসীমার ৩১ শতাংশ কিশোর বা তরুণের তুলনায়। গৃহ পরিষ্কারের কাজে ৫৮ শতাংশ ছেলেদের পাশে জ্বলজ্বল করিতেছে ৬৯ শতাংশ মেয়ে; বাজার করিবার বেলায় কেবল দুই পক্ষ কাছাকাছি, তবু মেয়েরাই আগাইয়া, ৫২ শতাংশ। ছোট ভাই-বোনকে দেখিয়া রাখিবার কাজেও ২৮ শতাংশ মেয়ের পাশে ১৬ শতাংশ ছেলের সুকৃতি নিতান্ত ম্রিয়মাণ। সমীক্ষা মাত্রেই শেষ কথা নহে, কিন্তু আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাক্কালে ব্রিটেনের এই তথ্য-পরিসংখ্যান বিশেষ অর্থবহ বলিয়া মনে করা যাইতে পারে।
মেয়েরা, এমনকি কিশোরী ও তরুণীরাও সার্বিক ভাবে গৃহস্থালির কাজ পুরুষ অপেক্ষা বেশিই করিয়া থাকে, প্রমাণিত হইল— সেই সন্তুষ্টিই এই সমীক্ষার একমাত্র প্রাপ্তি নহে। ভারতের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশে তো বটেই, ব্রিটেনের ন্যায় উন্নত দেশেও মেয়েরা সমবয়সি ছেলেদের অপেক্ষা সংসারে বেশি সময় ও শ্রম দিতেছে, এই তথ্যও গুরুত্বপূর্ণ। এতদ্ব্যতীত এই সমীক্ষার ফলাফলে মিশিয়া আছে অনেক অপ্রাপ্তি। চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিতেছে, ঘর গুছাইতে গিয়া আসলে মেয়েদের বাহিরটি অদেখা থাকিয়া যাইতেছে। সেই যন্ত্রণা বলিতেছে, সংসার সামলাইতে গিয়া কিশোরী ও তরুণীদের পড়াশোনায় মন দিবার সময় মিলিতেছে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকিলে তবু পড়া হইত, ঘরে থাকিবার কারণে যাবতীয় গৃহকর্মের বাধ্যবাধকতা মেয়েদের শিক্ষা হইতে দূরে ঠেলিতেছে। স্কুল-কলেজে না যাইতে পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে মানসিক স্বাস্থ্যও, সমীক্ষায় প্রতি পাঁচ জন মেয়ের এক জন বলিয়াছে যে, ঘরে থাকিবার ফলে তাহাদের সমস্যা হইতেছে। কোভিডকালে বিকল্প ব্যবস্থায় সুশিক্ষা মিলিতেছে না বলিয়া উদ্বিগ্ন ৪৬ শতাংশ মেয়ে। ব্রিটেনের ‘অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্স’-এর রিপোর্ট বলিতেছে, ঘর হইতে পড়াশোনা বা ‘হোম স্কুলিং’-এর তদারকির ভারও মেয়েদেরই কাঁধে, ৫২ শতাংশ পুরুষের পাশে ৬৭ শতাংশ মেয়ে সেই কাজ করিতেছে— নিজেদের পড়াশোনার ক্ষতির মূল্যে!
ব্রিটেনের চিত্রই যেখানে এইরূপ, ভারতের ছবিটি কেমন হইতে পারে, অনুমান করা চলে। সেই ছবি তুলিয়া ধরিবে কোভিডের গুরুতর সময়টি পার হইয়া আসিয়া বর্তমান বৎসরেও নারী ও পুরুষের প্রকট লিঙ্গবৈষম্য— শিক্ষা হইতে গৃহস্থালি, শ্রম হইতে মানবাধিকার, সর্বত্র। কোভিডজনিত বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ও কর্মসঙ্কটের শিকার নারী-পুরুষ উভয়েই, কিন্তু প্রবল বিপদের মুখেও লড়াই করিয়া জীবন চলিষ্ণু রাখিবার, সংসার ও সন্তানের গায়ে আঁচটুকু লাগিতে না দিবার ভার যেন আজও মুখ্যত নারীর উপরেই। সংসার টিকাইয়া রাখিবার আবহমান ঐতিহ্যের ভার একুশ শতকেও বহিতেছে নারীসমাজ। ব্রিটেনে তবু সমীক্ষার ফুরসত মিলিয়াছে, ভারতীয় নারী হয়তো বলিবে, ঘরে বিস্তর কাজ, এত প্রশ্নের উত্তর দিবার সময় কোথায়!