ফাইল চিত্র।
চিকিৎসা সফল না হইলেই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ দায়ের করা চলে না— একটি মামলা প্রসঙ্গে কথাটি জানাইল সুপ্রিম কোর্ট। কথাটি যে দেশের শীর্ষ আদালতকে বলিয়া দিতে হইতেছে, তাহা তাৎপর্যপূর্ণ। পান হইতে খয়ের খসামাত্র মামলা দায়ের করিবার এই প্রবণতার একাধিক বিপরীত ফল আছে। নিজেদের পিঠ বাঁচাইতে বহু ক্ষেত্রেই চিকিৎসকেরা অতিসাবধানী হন, যাহা ক্ষেত্রবিশেষে রোগীর স্বার্থের পরিপন্থী হইতে পারে। দীর্ঘ আইনি জটিলতাও কোনও পক্ষের পক্ষেই সুখদ অভিজ্ঞতা নহে। এবং, যে কোনও ক্ষেত্রেই যদি মামলা হয়, তবে যে ঘটনাগুলিতে সত্যই চিকিৎসকেরা দায়ী, সেই মামলাগুলির গুরুত্বও হ্রাস পায়। অতি আইন-নির্ভর সমাজে ইহা কার্যত অনিবার্য পরিণতি।
চিকিৎসায় গাফিলতি সংক্রান্ত মামলার একটি বিশেষ দিক আছে, যাহা অন্যান্য ক্রেতা সুরক্ষা মামলায় থাকে না। চিকিৎসাপদ্ধতির ঠিক-ভুল বিচার করা সাধারণ মানুষের, এমনকি অতি বিচক্ষণ বিচারকের পক্ষেও কঠিন। কারণ, চিকিৎসাশাস্ত্র সাধারণের অধিগম্য নহে। এই ক্ষেত্রে সমাধানের একটি সূত্র ইহা হইতে পারে যে, সরকার একটি বিশেষজ্ঞ কমিশন গঠন করিয়া দিবে, এবং চিকিৎসায় গাফিলতি সংক্রান্ত বিবাদে সেই কমিশনের রায়ই চূড়ান্ত বলিয়া মান্য হইবে। পশ্চিমবঙ্গে ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট আইনের মাধ্যমে এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। কিন্তু, সেই ব্যবস্থাও যে প্রশ্নাতীত হইবে, সেই নিশ্চয়তা নাই। কারণ, যাঁহাদের বিচার হইবে, এবং যাঁহারা
বিচার করিবেন— উভয়ের মধ্যে পেশাগত সম্পর্ক আছে। ফলে, অন্তত তর্কের খাতিরে এই আশঙ্কাটি উড়াইয়া দেওয়ার উপায় নাই যে, বিচারক চিকিৎসকরা অভিযুক্ত চিকিৎসকের প্রতি সহানুভূতিশীল হইতে পারেন। বিশেষত এই ক্ষেত্রে, যেখানে তাঁহাদের বিচারের ন্যায্যতা নির্ণয়ের সাধ্য অ-চিকিৎসকদের নাই। স্পষ্ট করিয়া বলা প্রয়োজন, ইহা চিকিৎসকদের সততাকে প্রশ্ন করা নহে— শুধু নির্দেশ করা যে, চাহিলে অন্যায্য সিদ্ধান্তের সম্ভাবনা থাকিয়াই যায়। ফলে, এহেন বিচারপ্রক্রিয়াকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখিতে হইলে তাহার উপর নজরদারি, এবং সেই নজরদারির উপর নজরদারি এবং তাহারও উপর নজরদারি— এমন একটি অনন্ত ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিতে হইবে। যাহা শুধু ব্যয়সাধ্যই নহে, সম্পূর্ণ অকুশলী।
এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হইল কেন যে, চিকিৎসকের প্রতি রোগীর আস্থার ন্যায় একটি অতি জরুরি এবং স্বাভাবিক বস্তুও দুর্লভ হইল? এই প্রশ্নের যে উত্তর হাসপাতালের পরিসরে মিলিবে, তাহা নিতান্তই খণ্ড ও অসম্পূর্ণ। মূল সমস্যাটি বৃহত্তর। ভারতের সমাজে পারস্পরিক, সামাজিক আস্থার স্তর নিচু। অর্থশাস্ত্রীরা গবেষণায় দেখাইয়াছেন, যে সমাজে পারস্পরিক বিশ্বাস কম, তাহা ক্রমেই অতি আইননির্ভর হইয়া উঠিতে থাকে, এবং অকুশলী হইয়া পড়ে। সেই সমাজে অতি সামান্য লেনদেনও দীর্ঘ লিখিত চুক্তি ভিন্ন হওয়া অসম্ভব। উচ্চ সামাজিক বিশ্বাসের যেমন একটি নিজস্ব ইকুইলিব্রিয়াম বা সাম্যাবস্থা আছে, নিম্ন সামাজিক বিশ্বাসেরও আছে। দুর্ভাগ্যক্রমে, ভারত সেই নিম্ন সামাজিক বিশ্বাসের সাম্যাবস্থায় আটকাইয়া আছে। চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কও সেই নিম্ন সামাজিক বিশ্বাসেরই ফল। এই সাম্যাবস্থা কী ভাবে ভাঙা সম্ভব, তাহা অতি বৃহৎ প্রশ্ন। সমাজ গবেষকরা দেখাইয়াছেন যে, দীর্ঘমেয়াদে কোনও সমাজের পক্ষে বিশ্বাসের স্তর পরিবর্তন করা সম্ভব। কিন্তু, শুধু সেই দীর্ঘমেয়াদের ভরসায় বসিয়া থাকিলে চলিবে না। আপাতত রোগীর পরিবারকে যেমন নিজস্ব বিবেচনা প্রয়োগ করিতে হইবে, চিকিৎসকদেরও তেমনই স্বচ্ছ হইতে হইবে। এবং, সরকারকে এই ভরসা দিতে হইবে যে, কোনও পক্ষের প্রতিই অন্যায় হইতে দেওয়া চলিবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy