ফাইল চিত্র।
গত বৎসর পশ্চিমবঙ্গের কোনও শিশুকন্যা ধর্ষিত হয় নাই। এক জনও কন্যাভ্রূণ হত্যা করে নাই কলিকাতায়। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো ২০২০ সালের রিপোর্ট এমনই বলিতেছে। দেখিয়া রাজ্যবাসী আশ্বস্ত হইবে না কি আশঙ্কিত, বোঝা দুষ্কর। যে শহরে শিশুকন্যার অনুপাত ৯৩৩, সেখানে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ তবে একটিও ঘটে নাই? রাজ্য হইতে গত বৎসর যে সাড়ে ছয় হাজারেরও অধিক শিশুকন্যা নিখোঁজ হইয়াছে, তাহারা সকলেই যৌন নির্যাতন হইতে সুরক্ষিত? না কি গর্ভস্থ কন্যাভ্রূণ হত্যা, শিশুকন্যার ধর্ষণ ঘটিলেও তাহা পুলিশের নথিতে নাই? সরকারি তথ্য অনুসারে নারী ও শিশুর প্রতি অপরাধের পরিসংখ্যানে দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরুর মতো শহরের তুলনায় ‘নিরাপদ’ কলিকাতা। প্রায় দেড় কোটি মানুষের এই মহানগরে গত বৎসর ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়াছে এগারোটি, পণের জন্য নিহত হইয়াছেন নয় জন বধূ। অতিমারি-আক্রান্ত সময়ে শহর ও শহরতলির পরিবারগুলি হইতে নিত্য গার্হস্থ হিংসার অভিযোগ উঠিয়াছে, তখন নারী নির্যাতনের পরিস্থিতিতে এমন ‘উন্নতি’ দেখিয়া বিভ্রান্ত হইতে হয়। পরিসংখ্যান দেখাইতেছে, কলিকাতায় নারী নির্যাতন কমিয়াছে, সমগ্র রাজ্যে কিঞ্চিৎ বাড়িয়াছে। অতঃপর তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলিয়াছেন, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি লইয়া বিরোধীদের অভিযোগ ‘রাজনৈতিক স্বার্থে মিথ্যা প্রচার’।
অগত্যা নাগরিক সমাজকে মনে করাইতে হইবে, অপরাধ সংক্রান্ত তথ্যে কোনও রূপ অসম্পূর্ণতা বা বিকৃতিও বস্তুত সামাজিক অপরাধ। মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায়, সংবাদমাধ্যমে, পুলিশ-আদালতের নথিতে যে চিত্র উঠিয়া আসিতেছে, তাহার সহিত সরকারি নথির সাক্ষ্য যদি না মেলে, তাহা হইলে নথিভুক্তির প্রক্রিয়াটি লইয়া চিন্তা প্রয়োজন। শিশু ও নারী পাচারে পশ্চিমবঙ্গ বরাবর রহিয়াছে শীর্ষে অথবা তাহার কাছাকাছি। তৎসহ, নাবালিকা বিবাহ এবং অকালমাতৃত্বেও রাজ্যের অবস্থা লজ্জাজনক। তাহার অর্থ, বাংলার মেয়েদের সামাজিক সুরক্ষা ও আইনি নিরাপত্তার অভাব যথেষ্ট। ফলে দিল্লি ও মুম্বইয়ের তুলনায় কলিকাতায় নারী নির্যাতনের সংখ্যা নগণ্য হইলে সন্দেহের উদ্রেক হয় অধিক— তবে কি ধর্ষণের চেষ্টা, গার্হস্থ হিংসা কমিয়াছে? না কি, সেই অপরাধগুলির জন্য নির্দিষ্ট আইনি ধারাগুলির প্রয়োগ কমিয়াছে? সরকারি নথিতে পরস্পর-বিরোধী এক চিত্র মিলিতেছে।
অসুখ হইতে অপরাধ, সর্বক্ষেত্রে পরিসংখ্যান লইয়া এই অর্থহীন খেলার অবসান হউক। সরকারি নীতি নির্ধারণ করিবার উপযুক্ত তথ্য-পরিসংখ্যান প্রস্তুত করিবার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং মনোবল দিতে হইবে পুলিশ-প্রশাসনকে। রাজনৈতিক চাপ অপসারিত হউক। নারী-হিংসাকে অবশ্যই আইনি উপায়ে প্রতিহত করিতে হইবে। কিন্তু ইহা কেবলই আইনশৃঙ্খলার বিষয়, এমন নহে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী-হিংসার কারণগুলি গভীর ও বহুমাত্রিক। সেইগুলির নিবারণ কেবল পুলিশ-আদালতের কাজ নহে। সরকারের প্রতিটি দফতর, প্রকল্প ও উদ্যোগে নারীর সমমর্যাদাকে সম্মুখে রাখিতে হইবে। নারী-হিংসাকে ‘সামান্য’ প্রতিপন্ন করিবার অর্থ, এই বৃহত্তর কর্তব্য রাজ্য সরকার অস্বীকার করিতেছে। মিথ্যা আশ্বাসে কাজ নাই, কঠিন সত্যের মোকাবিলা করিতে হইবে রাষ্ট্রকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy