Advertisement
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
Constitution of India

অমোচনীয়

সংবিধানের প্রস্তাবনায় গোড়া থেকে ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক শব্দ দু’টি ছিল না, ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে তা যোগ হয়।

শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২৪ ০৬:৪৩
Share: Save:

আবারও বিতর্ক, আবারও আঙুল তোলা। ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক, এই শব্দ দু’টিকে ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে বাদ দেওয়ার আর্জি জানিয়েছিলেন বিজেপির প্রাক্তন রাজ্যসভা সাংসদ সুব্রহ্মণ্যম স্বামী, সুপ্রিম কোর্ট সেই আর্জির শুনানি অগস্ট পর্যন্ত স্থগিত রেখেছে। কিন্তু তার আগে মাননীয় বিচারপতি যা বলেছেন তা মনে রাখার— ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি যে সংবিধানের মূল কাঠামোর অন্তর্গত, শীর্ষ আদালত তা একাধিক রায়ে আগেই জানিয়েছে; আর সমাজতান্ত্রিক শব্দের অভিধানগত অর্থ আমরা মেনে চলছি না, এর নিজস্ব সংজ্ঞা তৈরি হয়েছে।

সংবিধানের প্রস্তাবনায় গোড়া থেকে ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক শব্দ দু’টি ছিল না, ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে তা যোগ হয়। এই ঘটনাকেই হাতিয়ার করে সাম্প্রতিক কালে বিজেপির নানা নেতা বার বার প্রশ্ন তুলছেন সংবিধানের প্রস্তাবনায় এই ধারণা দু’টির, বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতার যৌক্তিকতা এবং ‘অস্তিত্ব’ নিয়েই। তাঁদের যুক্তি, শুরু থেকে না থাকার অর্থ— সংবিধান-প্রণেতারা এই শব্দ দু’টি আদৌ প্রস্তাবনায় যুক্ত করতেই চাননি। এ যুক্তি অত্যন্ত হাস্যকর— ১৯৭৬-এর আগে কি তবে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ছিল না, হিন্দু রাষ্ট্র ছিল? স্বাধীনতা-উত্তর কালের যৎকিঞ্চিৎ সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন নাগরিকমাত্রেই জানেন, ধর্মের ভিত্তিতে হওয়া দেশভাগের পরিণাম দেখেই স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রনেতারা আরও বেশি করে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে ভারতের সংবিধানের মূল কাঠামোয় অঙ্গীভূত করেছিলেন। জওহরলাল নেহরু তো বটেই, তৎকালীন গণপরিষদের সকল সদস্যও এই ঐকমত্যে আসতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি— স্বাধীন সার্বভৌম ভারত যে এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র তা বলার অপেক্ষা রাখে না, আলাদা করে উল্লেখ বাহুল্যমাত্র। তার পরেও যে তা আলাদা করে সংবিধানের প্রস্তাবনায় খোদিত হয়েছিল তার কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধী রাজনীতির ক্রমাগত মাথা তোলা বা বাড়বাড়ন্তের পরিস্থিতিতেও ভারত যেন তার মূল সুর থেকে কখনও বিচ্যুত না হয়।

বিজেপির শাসনামলের এই ভারতই প্রমাণ, সংবিধানের মূল সুরটি কতখানি বেসুরে বাজছে। আজ সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিতে শাসক দলের যাবতীয় তোড়জোড়, সুপ্রিম কোর্টের বারংবার মনে করিয়ে দেওয়াতেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। লোকসভা নির্বাচনের আগে ‘চারশো পার’-এর ঢক্কানিনাদে কেন্দ্রের এই বার্তাও প্রচ্ছন্ন ছিল, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভই শুধু বাকি, সংবিধান পাল্টানো তথা ধর্মনিরপেক্ষতার আনুষ্ঠানিক বিসর্জন সময়ের অপেক্ষামাত্র। আপাতত তা করা যায়নি, কিন্তু সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার উপরে নানাবিধ আঘাত যে ক্রমাগত আসতেই থাকবে তা পরিষ্কার। এই আঘাতের মুখে ভারতের বিচারব্যবস্থা এই মুহূর্তে ধর্মনিরপেক্ষতার যত্নশীল অভিভাবক। আদালত বারংবার বলেছে, ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু সংবিধানের মূল কাঠামোর ভিত্তিই নয়, সাম্যের ধারণারও তা অচ্ছেদ্য অঙ্গ, সব ধর্মকে ‘সমান’ দৃষ্টিতে দেখা, কোনওটির প্রতি পক্ষপাত কিংবা বিভেদ না দেখানোই সমত্ব। সমাজতান্ত্রিকতার ধারণা নিয়ে তবু আলোচনা ও তর্ক চলতে পারে, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে কোনও আপস নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE