শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক বদলির সঙ্গে শিক্ষা দানের সম্পর্ক ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। — ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গের স্কুলগুলিতে শিক্ষক বণ্টনের মামলায় সম্প্রতি কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসু প্রশ্ন করেছেন, “এটা কি জঙ্গলের আইন?” এই প্রশ্ন করতে পারেন রাজ্যবাসীরাও। সংবাদে প্রকাশ, যে স্কুলে ছাত্রছাত্রী নেই, সেই স্কুলের অনুমোদন বাতিল করে, সেখান থেকে শিক্ষকদের বদলি করতে গেলে ‘রাজনৈতিক চাপ’ আসে পর্ষদের উপরে, এ কথা আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছেন শিক্ষা দফতরেরই আইনজীবী। এমন অন্যায় চাপ সৃষ্টিই যেন আজ রাজনীতির পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক বদলির সঙ্গে শিক্ষা দানের সম্পর্ক ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। গ্রামের স্কুল শূন্য করে অধিকাংশ শিক্ষক আসছেন কলকাতা ও শহরতলিতে, আবার শহরগুলির বহু স্কুলে গুটিকয় ছাত্রছাত্রী সত্ত্বেও প্রচুর শিক্ষক বসে রয়েছেন। কোন নিয়মে এমন হিসাবহীন বদলি হয়, তার ব্যাখ্যা বিধিবদ্ধ সভ্য সমাজে পাওয়া সম্ভব নয় বলেই ‘জঙ্গলের আইন’ স্মরণ করতে হয়েছে বিচারপতিকে। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে উচ্চতম রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও তাঁদের ঘনিষ্ঠ আধিকারিকরা শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে নৈতিকতা ও শৃঙ্খলাকে কী ভাবে পদদলিত করেছেন, তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। শিক্ষক বদলির ক্ষেত্রেও সেই একই চিত্র। এমনকি হয়তো কিঞ্চিৎ কৌতুকের উদ্রেক হতে পারে এই তথ্যে যে, উৎকোচের পরিবর্তে শিক্ষক বদলির অভিযোগ এতই তীব্র হয়ে উঠেছিল যে, তৃণমূল সরকার ২০২১ সালে ‘উৎসশ্রী’ পোর্টাল চালু করে। অনলাইনে বদলির আবেদন গৃহীত হল, কুড়ি হাজারের বেশি শিক্ষক বদলিও হলেন, কিন্তু অস্বচ্ছতা বা অন্যায্যতার অভিযোগ মেটেনি। চালু হওয়ার বছরখানেকের মাথায় অনলাইন আবেদন গ্রহণ স্থগিত হয়েছে, বদলিও বন্ধ। তাতে শিক্ষক-বিরল স্কুলে পড়াশোনার কী হবে, তা নিয়ে অবশ্য উদ্বেগ বাড়তেই থাকে।
উদ্বেগ জাগে ‘রাজনৈতিক চাপ’ সৃষ্টিকারী নেতাদের আড়ালে থাকা শিক্ষকদের দেখেও। তাঁরা পড়ুয়াদের প্রতি অন্যায় নিবারণের চাইতে ব্যক্তিগত সুবিধাকে অধিক গুরুত্ব দিলেন, পরোক্ষে দুর্নীতিকে সমর্থনও জোগালেন। জঙ্গলের আইন থেকে যাঁরা লাভবান হন, তাঁদের থেকে শিক্ষণীয় কী থাকতে পারে? কী করা উচিত নয়, সেই শিক্ষাই বোধ হয় দিলেন তাঁরা। তবে বিস্মিত করে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষায় অব্যবস্থার ব্যাপকতা ও ধারাবাহিকতা। প্রশাসনে এক দশকের বেশি কাটিয়েও একটি ক্ষমতাসীন দল শিক্ষক নিয়োগ ও বদলির বিষয়ে যে ভাবে সব রীতি-নীতি লঙ্ঘন করল, তাকে কেবল ‘দুর্নীতি’ বললে কমই বলা হয়। এ এক জঘন্য কেলেঙ্কারি।
২০০৯ সালে শিক্ষার অধিকার আইন আসার পর স্কুলশিক্ষার পরিকাঠামোয় যে বিপুল বিনিয়োগ করেছিল কেন্দ্র এবং রাজ্যের সরকার, পশ্চিমবঙ্গের শিশুরা তার সুবিধা পেল না। তৃণমূল আমলে দেখা গেল, শিক্ষকের অভাবে একের পর এক সরকার-পোষিত প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিক স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বহু স্কুল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। হাই কোর্টে বিচারাধীন মামলাটিতে বদলির আবেদন করা হয়েছিল হাওড়ার যে স্কুলটি থেকে, সেখানে সাড়ে পাঁচশো পড়ুয়ার জন্য রয়েছেন আট জন শিক্ষক। কাছের স্কুল বন্ধ হওয়ার ফলে হয় শিশুরা ফের কয়েক কিলোমিটার দূরের স্কুলে যাচ্ছে, না হলে অভিভাবক সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তা-ও সম্ভব না হলে স্কুলছুট সন্তানকে ভিনরাজ্যে কাজ করতে, বা ভিনগাঁয়ে সংসার করতে পাঠাচ্ছেন। শিক্ষার অধিকার এ রাজ্যে যেন এক প্রহসনে পরিণত হয়েছে। রাজ্য সরকার এই পরিস্থিতির উদ্ভবের জন্য দায়ী। শুধু তা-ই নয়, এই পরিস্থিতির রাশ টানতে, শিক্ষকের যথাসম্ভব ন্যায্য বণ্টন করতে, সরকার বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি। প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি রাজনীতির এই নির্মায়িক উদাসীনতা ক্ষমার অযোগ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy