দশ দিন অতিক্রান্ত, দেশে নূতন টিকা-নীতি চালু হইয়াছে। তাহার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ফের নিজের পিঠ চাপড়াইয়া লইয়াছেন— দিনে রেকর্ড সংখ্যক টিকাকরণের জন্য; অন্য দিকে, এই দশ দিনের মধ্যেই বিভিন্ন রাজ্যে টিকার প্রভূত ঘাটতি হইতেছে। পশ্চিমবঙ্গেই যেমন, আগামী কয়েক দিনে যত টিকা প্রয়োজন, তাহার অতি সামান্য অংশই মজুত আছে। বাকি টিকা কবে মিলিবে, সেই প্রশ্নের উত্তর নাই। বস্তুত, উত্তর দেওয়ার যে আদৌ কোনও প্রয়োজন আছে, কেন্দ্রীয় কর্তারা তাহা স্বীকার করেন বলিয়াও সন্দেহ হয় না। তাঁহারা রাজনৈতিক তরজায় ব্যস্ত। যেখানে গোটা দেশে তৃতীয় সর্বোচ্চ টিকাকরণ হইয়াছে পশ্চিমবঙ্গে, সেখানে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অভিযোগ করিতেছেন যে, এই রাজ্যে টিকাকরণের হার দেশে সর্বনিম্ন! রাজনীতির সম্মুখে তথ্যের দাম কানাকড়িও নহে। আবার, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন আবেদন করিয়াছেন যে, তাঁহার রাজ্যে বেসরকারি হাসপাতালগুলির জন্য পঁচিশ শতাংশের কোটা হইতে পাঁচ শতাংশ-বিন্দু কাটিয়া তাহা রাজ্য সরকারকে দেওয়া হউক, কারণ সে রাজ্যে বেসরকারি কেন্দ্রে বিশেষ কেহ টিকা লইতেছেন না, কিন্তু সরকারি কেন্দ্রগুলিতে ভিড় উপচাইয়া পড়িতেছে। মোট কথা, নূতন টিকা-নীতিতে যাবতীয় পুরাতন সমস্যাই বিলক্ষণ টিকিয়া আছে— কতিপয় সমস্যার ‘মিউটেশন’ ঘটিয়াছে, এইমাত্র।
তাহার মূল কারণ, প্রধানমন্ত্রী যাহাকে টিকা-নীতি বলিয়া চালাইতে চাহিতেছেন, তাহাতে নীতির ভাগ যৎসামান্য। এই নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির মতামতের গুরুত্ব নাই। রাজ্যের পরিস্থিতি অনুসারে নীতিকে নমনীয় করিয়া লইবারও উপায় নাই। ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর আবেদনটি তাহার প্রমাণ। রাজ্যগুলির মধ্যে টিকা বণ্টনের সূত্রটি এখনও অবধি অস্বচ্ছ। জনসংখ্যা, টিকাকরণের হার, টিকার অপচয় ইত্যাদি বিষয় রাজ্যের কোটা নির্ধারণে বিবেচিত হইবে, নীতিতে জানা গিয়াছে— কিন্তু, কোনটির গুরুত্ব কত, তাহা যেমন অস্পষ্ট; তেমনই এই কথারও স্বীকৃতি নাই যে, টিকাকরণের হার টিকার জোগানের উপর নির্ভরশীল। ফলে, সূত্রটি গোলমেলে। টিকার উৎপাদন বৃদ্ধি, বিদেশি টিকার আমদানি ইত্যাদির ক্ষেত্রেও যে ধোঁয়াশা ছিল, তাহা বহুলাংশে বজায় থাকিয়াছে। বিদেশি টিকার ক্ষেত্রে ক্লিনিক্ল্যাল ট্রায়ালের নীতিটি এখন কী, তাহাও অজ্ঞাত। অর্থাৎ, যে সমস্যাগুলি ছিল, তাহার সবই রহিয়া গেল। নূতন নীতিতে প্রাপ্তি বলিতে সব বয়সের নাগরিককে বিনামূল্যে টিকা প্রদানের সিদ্ধান্ত।
এমন অবস্থা কেন, তাহা বিশ্লেষণ করিতে বসিলে যে সমস্যাটির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিতে হয়, তাহা এই প্রশাসনের আদিতম পাপ— অস্বচ্ছতা। একটি উদাহরণ বিবেচনা করিলেই সমস্যাটির চরিত্র স্পষ্ট হইবে। প্রথম যখন টিকাকরণ চালু হইল, তখন দুইটি ডোজ়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান স্থির হইল চার সপ্তাহ। যেই টিকার ঘাটতি দেখা দিল, সরকার কোভিশিল্ডের ক্ষেত্রে সেই ব্যবধান বাড়াইয়া করিলে বারো সপ্তাহ— অর্থাৎ, আগে যাহা ছিল, তাহার তিন গুণ। জানানো হইল, ইহাই নাকি আদর্শ ব্যবধান। বিশেষজ্ঞরা জানাইলেন, সরকারের এই দাবির কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নাই। অনুমান, জোগানের ঘাটতি সামাল দিতেই চাহিদা নিয়ন্ত্রণের এই ব্যবস্থা। আবার, সরকার প্রথমে বলিল, কেহ কোভিড-আক্রান্ত হইলে রোগ নিরাময়ের পর অন্তত নয় মাস অপেক্ষা করিতে হইবে টিকাকরণের জন্য। তাহার পর যেই টিকার জোগান বাড়িল, জানা গেল যে, ছয় মাস অপেক্ষা করিলেই চলিবে। তাহার পর জানা গেল, তিন মাসই যথেষ্ট। যথেষ্ট টিকা হাতে নাই বলিয়া তাহা দেওয়া যাইতেছে না, এই কথাটি স্বীকার না করিয়া যে সরকার ক্রমাগত নীতি পাল্টাইতে থাকে, তাহার নীতির উপর বিশ্বাস করা কঠিন কেন, তাহা বোঝা সম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy