মর্মতলে মত্ত আশা ফুঁসিতে থাকিবে, তবু অদৃষ্টের দোষে তাহা পূরণ হইবে না, কলি কি এমনই ঘনঘোর? না, নহে। সেই হতভাগ্য কাল এখন অতীত। তখন একটি মহাদেশ হইতে আর একটিতে যাইতেই কয়েক মাস কাটিয়া যাইত। তদুপরি কবিগণের স্বভাবদোষ অতিরঞ্জন। এক-আধ বার বিমানে চাপিলেন কি চাপিলেন না, লিখিয়া বসিলেন: “আকাশ আমায় ডাকে দূরের পানে”, গগনের আহ্বান যে কী বস্তু, তাহা এই যুগের ধনকুবেরগণের নিকট শিখিতে হইত। এক-এক জন তাঁহাদের আপনাপন সংস্থা নির্মিত যানে চাপিয়া মহাকাশে ঘুরিয়া আসিতেছেন। আশি কিলোমিটার উচ্চতা অবধি উঠিলেন রিচার্ড ব্র্যানসন, তাহা দেখিয়া আরও কুড়ি কিলোমিটার অধিক উঠিয়া গেলেন জেফ বেজোস। রীতিমতো টিকিট কাটিয়া ব্র্যানসনের যানে সওয়ার হইলেন এলন মাস্ক, যাঁহার সংস্থা আগামী বৎসর মহাকাশ পর্যটনের সুযোগ চালু করিবার ঘোষণা করিয়াছে। একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতায় কোনও গিরি বা মরুই আর দুর্গম-কান্তার নহে— গ্রীষ্মাবকাশ এখন কাটে আন্টার্কটিকায়, মন উচাটন হইলেই মাউন্ট এভারেস্টের উপরে কপ্টারযোগে এক পাক ঘুরিয়া আসা যায়। নিজ মর্ত্যসীমা কবেই চূর্ণ করিয়াছে মানবসভ্যতা; তাহার পদতলে চন্দ্র, যন্ত্রতলে মঙ্গল। কবি বড় পিছাইয়া পড়িয়াছেন। খবর রটিয়াছিল, টেনিদা কাহিনির বিচ্ছুপুত্র কম্বল নাকি চাঁদে নিরুদ্দেশ হইয়াছে, কেননা তাহার চাঁদে যাইবার ‘ন্যাক’ আছে। আগ্রহ আর অর্থের মিলন ঘটিলেই যে ব্যোমযাত্রা সম্ভব, কাহিনিকার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের পক্ষে কি তাহা কবিকে বুঝাইয়া বলা সম্ভব হইবে?
সমাজবিজ্ঞানের খটমট তত্ত্ব আবার ইহাকে ‘গ্লাস সিলিং’ বা স্ফটিকের ছাদের রূপকে বুঝিতে চাহিতেছে। হায়! কাহারা যেন সৌদি আরবে নারীরা গাড়ি চালাইবার অনুমতি পাইতেই উদ্যাপনে মাতিয়াছিলেন! তাঁহারা মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের এই মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করিতে পারিলেন না? আপাতত আক্ষরিক অর্থেই, সবার উপরে সত্যরূপে অধিষ্ঠিত মানুষের উপরে আর কিছুই নাই, অর্থবল থাকিলে সকল প্রকার সাধ আর সাধ্য মিলাইয়া দেওয়া কোনও কষ্টকল্পনা নহে। না হইলে কে আগে যানে চড়িবেন, তাহা লইয়াও কাড়াকাড়ি পড়িয়া যায়? সকলের জন্য মহাকাশের দরজা খুলিয়া যাইবার পর পাঁচ-ছয় জন সম্ভাব্য নভশ্চরের জন্য ২২ হাজার আবেদন জমা পড়িয়াছে। ঘরে ঘরে মহাকাশবিজ্ঞানী জন্ম লইতে পারে— এই ভয়ে আইনি পথে তাহার সংজ্ঞাই পাল্টাইয়া ফেলিতেছে আমেরিকা। অর্থবানেরা বুদ্ধিমানও বটে, ওই সব তকমায় তাঁহারা অবিচলিত, অনাগ্রহী। তাঁহাদের মূল ভাবটি ফুর্তির— রকেট বানাও, মহাগগনে যাও। হয়তো কেবল শীর্ষেন্দুবাবুর গল্পের কোনও গরিব গ্রামবাসীই ঠোঁট উল্টাইয়া বলিতে পারেন, বড়লোকের পেট গরম হইয়াছে। ইহাও ভুলিলে চলিবে না যে, এই শহরে শুধু কবি নহেন, এক জিনস-পরিহিত ও গিটার-নিলম্বিত নাগরিক কবিয়ালও আছেন। তিনিই সারসত্যটি বুঝিয়া গান বাঁধিয়াছিলেন: ‘টাকাটাই শেষ কথা, বাকি সব বাতুলতা’। সারা জীবন জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা চর্চা করিয়া, কৃষ্ণগহ্বরের রহস্য ভেদ করিয়া, এমনকি নোবেল বাগাইয়াও যাহা হইবার নহে, অর্থের বলে তাহা তুড়িতে অধিগত হইতেছে। অদৃষ্ট ইত্যাদিকে দোষারোপ করিবার আর প্রয়োজন নাই। মহাকাশ হইতে ক্লিষ্ট ধরিত্রীকে দেখিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়িলেই হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy