ইতিহাসের সঙ্গে কুস্তির গৈরিক জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্য খুঁজে পেয়েছে তার নতুন ‘শত্রু’— ঔরঙ্গজেবের সমাধি। মহারাষ্ট্রের ছত্রপতি সম্ভাজি নগর জেলায় অবস্থিত সমাধিস্থলটি ভেঙে ফেলার নিদান দিয়েছিলেন বিজেপি সাংসদ উদয়নরাজে ভোঁসলে; তার প্রতিক্রিয়ায় নাগপুরে বিপুল অশান্তি ঘটল। ভারতের দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বাস্তুতন্ত্র কী ভাবে চলে, মহারাষ্ট্রের ঘটনাক্রম তার এক প্রত্যক্ষ উদাহরণ। বিতর্কের সূত্রপাত ছাওয়া নামক এক বলিউডি ছবিতে শিবাজি-পুত্র সম্ভাজি ও মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের দ্বৈরথের অনতি-ঐতিহাসিক রূপায়ণে। সেই সূত্র ধরেই বিজেপি-শিবসেনা জোটের একাধিক নেতা-মন্ত্রী জাগিয়ে তুলতে চাইলেন ‘মরাঠি অস্মিতা’। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী যোগ দিলেন সেই বিদ্বেষ-যজ্ঞে; বললেন, তিনিও চান না যে, তাঁর রাজ্যে ঔরঙ্গজেবের সমাধি থাকুক, কিন্তু তাঁর হাত বাঁধা, কারণ সমাধিটি এএসআই-এর তত্ত্বাবধানে রয়েছে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও হুঙ্কার দিলেন, “যিনি ঔরঙ্গজেবকে নিজের আদর্শ বলে মনে করেন, তাঁর কি ভারতে থাকার অধিকার রয়েছে?” নাগপুরে ঔরঙ্গজেবের কুশপুত্তলিকা দাহ করল হিন্দুত্ববাদীরা, তার গায়ে জড়ানো সবুজ কাপড়। গুজব তৈরি হল, সেই কাপড়ে কোরানের আয়াত লেখা রয়েছে। তৈরি হল অশান্তি— পুলিশ ধরপাকড় আরম্ভ করল; দেখা গেল, যাঁরা গ্রেফতার হলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ধর্মে মুসলমান। তার কয়েক দিনের মাথায় সেই ঘটনায় দুই প্রধান অভিযুক্তর বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হল— বলা হল, নির্মাণ অবৈধ ছিল। অর্থাৎ, বিজেপির রাজত্বে ইদানীং যেমনটা হওয়া দস্তুর, মহারাষ্ট্রের কাহিনিও এসে দাঁড়িয়েছে সে বিন্দুটিতেই।
সে কারণেই, ঔরঙ্গজেবের সমাধির প্রশ্নটিকে নিছক এক ঐতিহাসিক কেন্দ্র হিসাবে না-দেখে, দেখতে হবে একটি প্রতীক হিসাবে। একদা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্র এখন যে ভাবে সংখ্যালঘু মানুষকে কোণঠাসা করতে তৎপর, এই সমাধিক্ষেত্রটি সেই আখ্যানের একটি উপাদানমাত্র। ঔরঙ্গজেব মানুষ বা শাসক হিসাবে কেমন ছিলেন, তা ইতিহাসবিদদের আলোচনার বিষয় হতে পারে, কিন্তু একুশ শতকের সমাজজীবনের প্রশ্ন হতে পারে না। তাঁর সমাধিস্থলটিও এক ঐতিহাসিক অস্তিত্বমাত্র, তার উপরে বিশেষ তাৎপর্য আরোপ করারও কথা নয়। কিন্তু, দক্ষিণপন্থী রাজনীতি সচেতন ভাবেই সেই কাজটি করে। তা শুধু ইতিহাসকে অস্বীকার করার, বা ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার প্রকল্প নয়— তার কারণটি গভীরতর। ইতিহাসকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে তা বর্তমানের সংখ্যালঘুদের বিপন্নতা বাড়ানোর প্রকল্প। সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে সংঘাত বাধা এক প্রকার অনিবার্য, এবং সেই সংঘাত দমনের নামে দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রযন্ত্র আরও এক বার ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে সংখ্যালঘু মানুষের উপরে। বুঝিয়ে দিতে পারে, এই দেশে গৈরিক বুলডোজ়ার যে কোনও দিন তাঁদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিতে পারে, রাষ্ট্র তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করতে পারে রাষ্ট্রদ্রোহের ভয়ানক অভিযোগ। অতীত আসলে বর্তমানের নিপীড়নের যুক্তিমাত্র।
উস্কানির এই রাজনীতি সম্বন্ধে সচেতন হওয়া প্রত্যেক উদারবাদী ভারতীয়র কর্তব্য। মনে রাখা প্রয়োজন, মহারাষ্ট্রে যা হল, তা নিতান্তই একটি বলিউডি ছবিকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া আবেগের বিস্ফোরণ নয়— তা একটি সুপরিকল্পিত ঘটনাক্রম। এবং, শুধু অতীতকে ব্যবহার করেই নয়, যে কোনও উপলক্ষকেই এই কাজে লাগাতে পারে দক্ষিণপন্থী বাস্তুতন্ত্র। যেমন, এপ্রিলের গোড়াতেই রামনবমী আসছে। তার মিছিলকে কেন্দ্র করে সংঘাত ইদানীং ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠেছে। লক্ষ করার, এ বারও তেমন সংঘাত ঘটলে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে তার প্রতিক্রিয়া কী হয়। আশঙ্কা হয়, সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে কঠোরতম ধারায় অভিযোগ দায়ের, আইনবহির্ভূত ‘শাস্তি’র ব্যবস্থা ইত্যাদি প্রবণতা অব্যাহতই থাকবে। সংখ্যালঘুকে দমন করার কোনও সুযোগ গৈরিক জাতীয়তাবাদীরা হাতছাড়া করবেন না।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)