আমেরিকা জুড়ে যখন শুধুই ‘অভিবাসী খেদাও’-এর দামামা, পশ্চিম ইউরোপের নানা দেশেও ‘স্বদেশি বনাম বহিরাগত’ দ্বৈরথ, সেই আবহেই সম্প্রতি ভারতের নীতি-নির্ধারকেরা লোকসভায় ‘ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ফরেনারস বিল, ২০২৫’ চূড়ান্ত করার কাজে নেমে পড়লেন। এ হয়তো নেহাতই এক সমাপতন, এবং ‘বিল’ থেকে ‘অ্যাক্ট’ হয়ে ওঠার যাত্রাটিও খুব সহজ নয়, তবু বিশ্ব রাজনীতির সাম্প্রতিক ঘটনাক্রমের আতশকাচে দেখলে কিছু প্রশ্ন ও সংশয় জাগে। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির রাজনৈতিক বয়ানের সূত্রে ‘বহিরাগত’, ‘বিদেশি’-র মতো শব্দ ও ধারণাগুলি আজকের ভারতে খুব স্বস্তিকর নয়; বিদেশিকে বিধর্মী হিসেবে দেখলে সেই রাজনীতির বয়ানের সুবিধা হয়। ক্ষমতায় থাকা দল ও তার জোটসঙ্গীদের এই মনোভাব সরকার, শাসনব্যবস্থা ও সর্বোপরি আইনপ্রক্রিয়ায় কতটা প্রভাব ফেলছে, তার নিরিখেও এই নতুন বিলের পর্যালোচনা জরুরি।
বলা হচ্ছে, এই বিলটির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার আসলে অভিবাসী ও বিদেশি সংক্রান্ত আইনকে পোক্ত করতে চাইছে। সে কারণে পুরনো চারটি আইন প্রত্যাহার করা হয়েছে, তার মধ্যে তিনটিই স্বাধীনতা-পূর্ব আইন। একাধিক জটিল আইন না রেখে একটি আইনের মাধ্যমে ভারতে আসা বিদেশিদের আগমন ও প্রস্থান, রেজিস্ট্রেশন ও ভিসা নিয়ন্ত্রণ করবে কেন্দ্র, তাতে দু’পক্ষের কাজই সহজ হবে, এমনই প্রত্যাশিত। কিন্তু আইনের শুধু মারপ্যাঁচ নয়, ফাঁকও থাকে— নতুন বিলটিও ব্যতিক্রম নয়। বিলে বলা আছে, যিনি ভারতের নাগরিক নন, তিনিই ‘বিদেশি’। এ যুগের অভিবাসন-পরিস্থিতিতে সংজ্ঞাটি অতি সঙ্কীর্ণ— ‘পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি’ প্রত্যাশী, এ দেশে পড়তে আসা ছাত্র, পর্যটক, পরিযায়ী শ্রমিক, শরণার্থী, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী বা রাষ্ট্রহীন মানুষ, ব্যাপকার্থে সকলেই ‘বিদেশি’। এই প্রতিটি স্তরের মানুষ, তাঁদের আইনি ও আর্থ-সামাজিক ভিন্নতা কি নতুন বিলে স্বীকৃত? রাষ্ট্রহীন বা ‘স্টেটলেস’ মানুষ সম্পর্কেও এই বিল নীরব। আইন-ভঙ্গকারী বিদেশিদের বিচার সম্পর্কে বিলে নানা দণ্ডের কথা বলা আছে, কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, কেউ বিদেশি কি না তা প্রমাণের দায় সেই মানুষটিরই, রাষ্ট্রের নয়। অভিযুক্ত মানুষটির এতে সমূহ বিপত্তি হতে পারে, রাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে দাঁড়ানো আজ ভারতীয়দের পক্ষেই দুঃস্বপ্নের মতো, ভিন দেশের নাগরিকের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক। আটক বা কারারুদ্ধ বিদেশিদের এই দেশ ছাড়া নিয়েও বিলে রয়েছে বিস্তর ধোঁয়াশা।
নামে গণতান্ত্রিক, এমন অনেক রাষ্ট্রই ভুলে যেতে বসেছে যে, বিদেশিরও আছে নাগরিক অধিকার, সর্বোপরি মানবাধিকার। নতুন বিলে স্পষ্ট বা প্রচ্ছন্ন অনেক কিছুই রাষ্ট্রের হাতে সেই অধিকার লঙ্ঘন ও খর্ব করার ক্ষমতাটি হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, এটিই সবচেয়ে আশঙ্কার। বর্তমানে প্রচলিত আইন ও প্রস্তাবিত বিলেও ভারতরাষ্ট্র সেই ক্ষমতার অধিকারী, যার জোরে কেন্দ্র কোনও বিদেশিকে যখন যা খুশি নির্দেশ দিতে পারে: চলাফেরার নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ, এমনকি সরকারের চোখের সামনে একটিমাত্র জায়গায় থাকার নির্দেশও। নিয়ন্ত্রণের এই প্রবণতা রূপ নিতে পারে স্বেচ্ছাচারে। আইন হয়ে ওঠার আগে তাই এই বিলের প্রতিটি অনুপুঙ্খ যাচাই করা প্রয়োজন, অবিলম্বে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)