Advertisement
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
RSS

তামাশা নয়, উদ্বেগ

উগ্র আধিপত্যবাদের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য: সামাজিক সম্মতি উৎপাদন। গর্ভসংস্কার তার একটি প্রকরণ। এই কর্মসূচি তামাশার ব্যাপার নয়, গভীর উদ্বেগের বিষয়।

picture of rss.

গর্ভাধান থেকে শুরু করে সন্তান-জন্মের পরে প্রায় দু’বছর অবধি হাজার দিনের গর্ভসংস্কার কর্মসূচি তাঁদের। প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৩ ০৮:৫৬
Share: Save:

অভিমন্যু মাতৃগর্ভেই চক্রব্যূহে প্রবেশের কৌশল শিখেছিলেন। নিষ্ক্রমণের পাঠ অশ্রুত থেকে যায়। অর্ধশিক্ষার পরিণাম ভয়ঙ্কর হয়েছিল। সংবর্ধিনী ন্যাস নামক সংগঠনটি সে-দিন হস্তিনাপুরীতে হাজির থাকলে নিশ্চয়ই শিক্ষা সম্পূর্ণ করে ছাড়ত। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মহিলা শাখার সংশ্লিষ্ট এই সংগঠন আটঘাট বেঁধে গর্ভস্থ শিশুর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে তৎপর হয়েছে। গর্ভাধান থেকে শুরু করে সন্তান-জন্মের পরে প্রায় দু’বছর অবধি হাজার দিনের গর্ভসংস্কার কর্মসূচি তাঁদের। তার একটি বড় অংশ হল পড়াশোনা। ওঁদের নির্দেশ: সন্তানসম্ভবা জননীকে সংস্কৃত বই পড়তে হবে। বইয়ের তালিকাও নিশ্চয়ই দিয়ে দেওয়া হবে, তা না হলে আবার বাৎস্যায়ন-আদি রসের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। কিন্তু সংস্কৃত শেখা তো সহজ কথা নয়! মাভৈ। হিন্দু ভারত গড়বার ‘মেড ইজ়ি’ প্রস্তুত: অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা সব মন দিয়ে রাম, হনুমান, শিবাজি ইত্যাদির জীবনকাহিনি পড়বেন, তা হলেই ‘দেশপ্রেমী ও সংস্কারী’ শিশুরা— সাদা বাংলায় তৈরি ছেলেরা— ভূমিষ্ঠ হবে। সঙ্ঘ পরিবারের সংগঠনটি এই বিষয়ে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিল, নাগপুরে কিংবা ঝান্ডেওয়ালায় নয়, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে!

সংস্কার নয়, উৎকট কুসংস্কারের এই প্রদর্শনীতে আজ আর নতুন করে অবাক হওয়ার কোনও উপায় নেই, কোভিড সারাতে গোমূত্র সেবন থেকে শুরু করে গণপতির প্লাস্টিক সার্জারি অবধি অবিদ্যা এবং কুশিক্ষার অগণন দৃষ্টান্ত স্মৃতিপটে দগদগ করছে। প্রত্যাশিত ভাবেই এই কর্মসূচি নিয়ে নানা ব্যঙ্গকৌতুক রচিত ও প্রচারিত হয়েছে। তামাশার বিষয় নিয়ে তামাশা করা হবে, সেটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই উদ্যোগকে যদি নিছক তামাশার বিষয় হিসাবেই দেখা হয়, সেটা কেবল মস্ত ভুল নয়, অত্যন্ত বিপজ্জনকও বটে। তার কারণ, যা এই সে-দিনও অকল্পনীয় ছিল, আজ তাকে নিতান্ত স্বাভাবিক বলে গণ্য করবার মানসিকতা এই ভাবেই সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বিদ্যাচর্চার উৎকর্ষ এবং মুক্তচিন্তার সমৃদ্ধির জন্য এই সে-দিন অবধি যে শিক্ষায়তন বিশ্ববিশ্রুত ছিল, সেই জেএনইউ’তে আজ চিকিৎসকদের ডেকে গর্ভসংস্কার বিষয়ক সম্মেলন হচ্ছে, এই ঘটনা যতটা ধাক্কা দেয়, তার থেকে অনেক বেশি ধাক্কা দেয় এই সত্য যে, এমন কলঙ্কজনক ঘটনা নিয়ে দেশে কোথাও বিশেষ কোনও তাপ-উত্তাপ নেই, যেন এমনটা হতেই পারে। কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস এখনও সমাজের বিস্তীর্ণ অংশে প্রবল, সে-সত্য নতুন নয়। কিন্তু তাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার এবং প্রবল উদ্যমে তার প্রসার ঘটানোর এই আয়োজন গত এক দশকে যে ভাবে বেড়েছে, তাকে অভূতপূর্ব বললে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হয় না।

এহ বাহ্য। গোটা কর্মসূচিটির মধ্য দিয়ে উদ্যোক্তারা যে ধারণাটিকে সমাজমানসে— কেবল অন্তঃসত্ত্বা মেয়েদের মনে নয়, আরও অসংখ্য নারী এবং পুরুষের মনে— গভীর ভাবে সঞ্চারিত করতে চাইছেন, তার নাম হিন্দুত্ব। উগ্র, অসহিষ্ণু, রাজনৈতিক হিন্দুত্ব। পুরাণে বা ইতিহাসে বিবিধ বীরপুরুষের যে ছবি আঁকা হয়েছে, তার নানা দিক, নানা মাত্রা। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পে সেই বহুমাত্রিকতার কিছুমাত্র মূল্য নেই, সেখানে ধনুর্ধর রাম কিংবা ছত্রপতি শিবাজি এক দিকে ‘হিন্দু’ হৃদয়ের আরাধ্য, অন্য দিকে পিতৃতান্ত্রিক পৌরুষের প্রবল প্রতিমূর্তি। সেই মূর্তি এক দিকে সংখ্যালঘুকে দমন করবার প্রেরণা দেবে, অন্য দিকে মেয়েদের আনুগত্যের খাঁচায় স্বেচ্ছাবন্দি রাখবে। পিতৃতন্ত্র এবং সংখ্যাগুরুতন্ত্রের এই যৌথ অভিযানে জননী তথা নারীকে যত বেশি শামিল করা যাবে, অভিযান তত জোরদার হবে। উগ্র আধিপত্যবাদের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য: সামাজিক সম্মতি উৎপাদন। গর্ভসংস্কার তার একটি প্রকরণ। এই কর্মসূচি তামাশার ব্যাপার নয়, গভীর উদ্বেগের বিষয়।

অন্য বিষয়গুলি:

RSS Women
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy