—ফাইল চিত্র।
এক প্রস্ত হাসাহাসি আর কিছুটা হইচই হয়েছিল, যখন জনপ্রিয় এক হিন্দি ওয়েব সিরিজ়ে দেখানো হল, উত্তরপ্রদেশের গ্রামে এক মহিলা পঞ্চায়েত প্রধানের স্বামী— প্রাক্তন প্রধান ও বর্তমান প্রধানপতি— ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। তার পর ঢোঁক গিলতে হল যখন পর্দার ফারাকটুকু ঘুচিয়ে দিল বাস্তব: মধ্যপ্রদেশে দু’বছর আগে ভাইরাল ভিডিয়োয় দেখা গেল, পঞ্চায়েত স্তরে নির্বাচিত মহিলা জনপ্রতিনিধিদের বদলে মঞ্চে শপথ নিচ্ছেন তাঁদের স্বামী কিংবা পুরুষ আত্মীয়রা। হট্টগোল, ফের এক বার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান, প্রশাসনিক তদন্ত, এ সব পেরিয়ে সরকার যে আছে সরকারেই তার সাম্প্রতিকতম নমুনাটি এই পশ্চিমবঙ্গের, পূর্ব মেদিনীপুরে জেলাশাসক দফতরের বিজ্ঞপ্তিতে জেলার মহিলা পঞ্চায়েত প্রধানদের প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দিতে বলা হল তাঁদের স্বামীদেরও।
প্রশাসনের, বিশেষত পঞ্চায়েত স্তরের জটিল কাজ মহিলারা একা করতে অপারগ, এই পুরুষতান্ত্রিক ভাবনাই কার্যক্ষেত্রে স্বামী তথা পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ছড়ি ঘোরানোর জায়গা করে দিচ্ছে— এ এক সামাজিক বিচ্যুতি। এই বিচ্যুতিকে মেরামত করে নারীর ক্ষমতায়নের প্রকৃত উদাহরণ হয়ে ওঠার কথা ছিল যার, সেই প্রশাসন তথা সরকারই উল্টে সেই বিচ্যুতিকে প্রতিষ্ঠা দিচ্ছে, মহিলা পঞ্চায়েত প্রধানদের স্বামীদের প্রশিক্ষণে ডেকে আনছে, এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছুই নয়। কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে মহিলাদের সুষ্ঠু ভাবে কাজ করতে হলে স্বামীর সহযোগিতা, যে স্বামীরা আগে প্রধান ছিলেন তাঁদের পূর্ব-অভিজ্ঞতা জরুরি। কিন্তু এই সহযোগিতা প্রশাসন অন্য হাজারো উপায়ে নিশ্চিত করতে পারত, এবং তা-ই হওয়া উচিত ছিল। রাজ্য সরকার তো তা করলই না, বরং এই বার্তাটি ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিল যে, মহিলা জনপ্রতিনিধিরা স্বামীদের ছাড়া কার্যত অচল।
শুধুই সমাজের পশ্চাদ্বর্তিতার প্রশাসনিক প্রতিফলন এ নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে রাজনৈতিক অভিসন্ধিও। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি এখনও প্রবল পুরুষতান্ত্রিক, এবং খেয়াল করলে দেখা যাবে, রাষ্ট্র যত মেয়েদের ক্ষমতায়নের পথে নানা পদক্ষেপ করছে, রাজনীতি ততই সে পথে কাঁটা বিছিয়ে যাচ্ছে। সংসদে যতই মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ হোক, নির্বাচনে মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ আসন সংরক্ষিত হোক, কাজের বেলায় মহিলা জনপ্রতিনিধিদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে প্রবল বাধাবিঘ্নের সঙ্গে, যার বহুলাংশই রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত ও প্রভাবিত প্রশাসনের ‘অবদান’। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠানগুলির নানা স্তরে তো বটেই, অঙ্গনওয়াড়ি-সহ অন্য একগুচ্ছ কল্যাণমূলক সরকারি প্রকল্পের কাজ নির্বাহ হচ্ছে মূলত গ্রামীণ শ্রমজীবী মহিলাদের দ্বারা। তাঁরা মাঠেঘাটে স্কুলে রাস্তায় গ্রামে কাজ করেন, তার জেরে কর্মক্ষেত্রে ও পরিবার দু’জায়গাতেই দুর্ভোগও পোহান, অথচ তাঁদের প্রয়োজন-প্রতিবাদ দাবিদাওয়া নিয়ে কোনও কথা হয় না। গার্হস্থ হিংসা রোধে বা পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করার পথে তাঁদের কণ্ঠস্বর গুরুত্বহীন, কার্যত অনুপস্থিত। ভোটের আগে রাজনৈতিক দলগুলি নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বড় বড় কথার ফুলঝুরি ছোটায়, ক্ষমতায় এসে পুরুষতন্ত্র ও রক্ষণশীলতার স্বমূর্তি ধরে। ঘরের পুরুষেরা পরের কথা, নির্বাচিত মহিলা জনপ্রতিনিধিদের সরকার কতটা সাহায্য করছে, সত্যিই করছে কি না, সেটাই আসল প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy