এক বছর আগে, ২০২৩ সালের শেষ দিনটিতে এই স্তম্ভে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল: “ভারতীয় গণতন্ত্র কি নির্বিবাদে একাধিপত্যের কৃষ্ণগহ্বরে প্রবেশ করছে? বর্ষশেষে হাতে রইল এই প্রশ্ন।” এ-প্রশ্নে নিহিত ছিল গভীর আশঙ্কা। এক দিকে, ভারতীয় রাষ্ট্রের শাসকদের সর্বগ্রাসী আধিপত্য বিস্তারের উৎকট অভিযান থেকে উঠে এসেছিল এই আশঙ্কা। অন্য দিকে, ২০২৪ সালে নির্ধারিত লোকসভা নির্বাচনে শাসকরা তাঁদের মেরুকরণের প্রযুক্তি ও কৌশল প্রয়োগ করে আধিপত্যের ভিত আরও মজবুত করে তুলবেন, এমন সম্ভাবনা প্রবল আকার ধারণ করেছিল। ভারতের পরম সৌভাগ্য, সেই আশঙ্কা সত্য হয়নি। এই সৌভাগ্য কোনও পড়ে-পাওয়া চোদ্দো আনা নয়, আপন শক্তিতে তাকে অর্জন করে নিয়েছে এ দেশের জনসমাজ। বহু জল্পনা, বিপুল প্রচার এবং রকমারি পূর্বাভাসকে মিথ্যা প্রমাণ করে অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন আক্ষরিক অর্থেই ইতিহাস রচনা করেছে। বর্ষশেষের প্রশ্নের উত্তরে জনাদেশ সপাটে জানিয়ে দিয়েছে: না, কোনও কৃষ্ণগহ্বর তার মর্যাদাকে গ্রাস করতে পারেনি। রাজা বদলায়নি, কিন্তু জনতার রায়ে রাজশক্তি পরনির্ভরশীল হতে বাধ্য হয়েছে। শাসকের আধিপত্য ভাঙেনি, কিন্তু মচকেছে। গণতন্ত্রের নিজস্ব যুক্তিতেই এই ঘটনা অ-সামান্য। ২০২৪ এই কারণেই ঐতিহাসিক।
নির্বাচন-পরবর্তী ঘটনাপরম্পরায় সেই ঐতিহাসিকতা কি তার প্রাপ্য মর্যাদা পেয়েছে? শাসক এবং বিরোধী, দুই শিবিরের নায়কনায়িকারা কি আপন আপন কর্তব্য পালন করেছেন? দুর্ভাগ্যের কথা এবং উদ্বেগের কথা এই যে, এই প্রশ্নেরও নিঃসংশয় উত্তর: না। শাসকের কাজ ছিল জনমতের অন্তর্নিহিত অনুজ্ঞাকে আন্তরিক স্বীকৃতি দিয়ে একাধিপত্যের কুপথ ছেড়ে একটি সত্যকারের উদার, সহিষ্ণু, আলোচনাভিত্তিক শাসনের নবনির্মাণে মন দেওয়া। কিন্তু তাঁদের কাছে তেমন আত্মশুদ্ধির প্রত্যাশা করা বোধ করি নিছক বাতুলতা। একাধিপত্য তাঁদের স্বর্গ, তাঁদের ধর্ম, তাঁদের পরমং তপঃ। অতএব অভ্যস্ত তৎপরতায় সংসদীয় সংখ্যার ঘাটতি পুষিয়ে নিয়ে তাঁরা অতি দ্রুত নিজমূর্তি ধারণ করেছেন, ‘এক দেশ এক ভোট’ আদি বিবিধ উদ্যোগ নিয়ে তৎপরতা বাড়ছে, কৃষ্ণগহ্বর উত্তরোত্তর প্রকট হচ্ছে। অন্য দিকে, বিরোধী মঞ্চের সংহতি দূরস্থান, সমন্বয়ের চেহারাও ক্রমশই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে চলেছে। একাধিক রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে ‘অস্বাভাবিক’ বিপর্যয়েও দলনেতাদের সম্বিৎ ফেরেনি। শাসক শিবিরের কোন নেতা কখন ‘মুখ ফস্কে’ বাবাসাহেব আম্বেডকরের নাম আপত্তিকর ভঙ্গিতে উচ্চারণ করবেন, সেই ভরসায় যদি বিরোধী দলগুলি বসে থাকে, তবে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে না।
আধিপত্যবাদী শাসক এবং ছন্নছাড়া বিরোধী শিবিরের এই সমাহার বিভিন্ন রাজ্যেও প্রকট। পশ্চিমবঙ্গ তার ব্যতিক্রম নয়। দুর্নীতি এবং দুঃশাসন অনেক দিন যাবৎ এই রাজ্যের মজ্জাগত ব্যাধিতে পরিণত, সেই ব্যাধির প্রকোপ উত্তরোত্তর বাড়ছে। কেন্দ্রের শাসক দলটিই এ-রাজ্যে প্রধান বিরোধী, সুতরাং গণতন্ত্র কার্যত উভয় সঙ্কটে। এই পরিস্থিতিতেই চিকিৎসক শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক হত্যাকে কেন্দ্র করে সুদীর্ঘ সামাজিক বিক্ষোভ এক নতুন এবং কার্যত অভূতপূর্ব সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, যে সম্ভাবনার কারণে ২০২৪ সাল কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের সচেতন নাগরিকদের কাছে স্বতন্ত্র মর্যাদা দাবি করতে পারে। সেই দাবি পূরণ করতে হলে সামাজিক আন্দোলনকে আরও অনেক দূরে যেতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ এখন বহু দিক থেকেই এক ব্যর্থ, হতাশ, মধ্যমানের রাজ্যে পরিণত। নিজেকে নিয়ে তার যথার্থ গৌরববোধ নেই, সুতরাং সামাজিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক নবজাগরণের স্বপ্ন দেখতেও সে ভুলে গিয়েছে। বছরের শেষ কয়েক মাসে যে সামাজিক আলোড়ন দেখা গেল, তার গভীর থেকে সেই স্বপ্নের পুনর্জন্ম হবে কি না, আগামী বছরের কাছে সেই প্রশ্নই রেখে যাচ্ছে ২০২৪ সাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy